বৃহঃ. মার্চ ২৮, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

67মনিরুল ইসলাম পারভেজ, চট্টগ্রাম: একটা সময় ছিল যখন গ্রাম-বাংলার ধান ভানার একমাত্র যন্ত্রই ছিল ঢেঁকি। গ্রামের কৃষাণী থেকে শুরু করে জমিদারবাড়ি পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল এ ঢেঁকির প্রচলন। প্রাচীন কাল থেকে এই উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। তখন বাংলার ঘরে ঘরে চিড়া কোটা, চাল ও চালের গুড়া করার জন্য ঢেঁকিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের শহর থেকে শুরু করে গ্রামে গঞ্জেও এখন পুরোপুরি যান্ত্রিক ঢেউ লেগেছে। ফলে দিন দিন একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের এ যন্ত্রটি (ঢেঁকি)।
৭০ এর দশকের পর ইঞ্জিন চালিত ধান ভাঙা কল আমদানির পর গ্রাম অঞ্চল থেকে ঢেঁকি বিলীন হওয়া শুরু হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ঐতিহ্য বাহী ঢেঁকি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের স্বাদ। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি শিল্পকে। ডিজিটাল যুগের আগামী প্রজন্ম ঢেঁকি কি তা চেনে না বললেই চলে। সব এলাকাতেই বর্তমান আধুনিক যুগে ঢেঁকির পরিবর্তে ধান ছাঁটাইসহ চালের গুঁড়া তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎচালিত মেশিনে। আর বিদ্যুৎচালিত মেশিনে ধান ছাঁটাই করার পর ওই চালগুলোতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইউরিয়া সার দিয়ে পালিশ করে তা চকচকে করে বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে জনমুখে। বাঙালির প্রধান খাদ্যবস্তু এই চালের সাথে রাসায়নিক মেশানোটা যে প্রযুক্তির আশির্বাদেই হচ্ছে তা বলা ঠিক হবে না। মুনাফালোভী এই কাজটা হচ্ছে আমাদের নৈতিক অধঃপতনের কারণে।

মাছে ভাতে বাঙালির ঘরে এক সময় নবান্নের উৎসব হতো ঘটা করে। উৎসবের প্রতিপাদ্যটাই ছিল মাটির গন্ধ মাখা ধান। ছিল ঢেঁকিতে ছাঁটা ধানের চালের ভাত আর সুস্বাদু পিঠার আয়োজন। রাতের পর রাত জেগে শরীরটাকে ঘামে ভিজিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানার পর প্রাণখোলা হাসি হাসত গাঁয়ের বধূরা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই যন্ত্রটির সাথে কতো গল্প-কাহিনি যে জড়িয়ে আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। গাঁয়ের বধুরা রাত জেগে ধান ভানার সময় কতো আনন্দ, হাসি-ঠাট্টায় যে মেতে উঠত তারও কোন ইয়ত্তা নেই। ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের হাসি-তামাশার কথা বলতো আর মনের সুখ-দুঃখের গান গাইতো। গ্রামের মেয়েরাও পালাক্রমে ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল তৈরির সময় নানা গীত পরিবেশন করত। ঢেঁকির ঢেঁকুর ঢুঁকুর মিষ্টি মধুর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনের সুখে গান শুনতে শুনতে বৃদ্ধাদেরও চলতো পান খাওয়ার আড্ডা। আজকাল যা কেবলই স্মৃতি। কালের বিবর্তণে আর যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে গ্রাম বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে।
বাঙালি জীবনাচারণের আরেকটি বড় অংশ ছিল নবান্ন উৎসব। গ্রামে এক সময় নতুন ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হতো। সেই উৎসবে পরিবারের শিশু-কিশোররা কত না আমোদ-আহ্লাদে নাচতো আর গাইতো। বাঙালি জীবনের এই উৎসবটার সাথেও ছিল ঢেঁকির সম্পর্ক। ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের আটা হতে তৈরি হত নানা উপাদেয় বাহারী সাজের রকমারি পিঠা। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। প্রবাদে আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। এক সময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ ফুটিয়ে তুলত নবান্ন উৎসব।
গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য ধারণকারী এই যন্ত্রটির কদর বাড়ানোর কথা বলাটা বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখন হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়। তবে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে
ঐতিহ্যগুলোকে ভুলে গেলে চলবে না। নয়তো বা আমাদের আজকের দিনের যাবতীয় কর্মযজ্ঞের কথাও ভুলে যাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যাতে বাংলার এসব সংস্কৃতির সাথে নিজেদের মেলবন্ধন স্থাপন করতে পারে সেজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে আমাদের হারানো ঐতিহ্যগুলো নিয়ে বিশেষ মেলা আয়োজন করলে ও এগুলো রক্ষার্থে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলে বর্তমান প্রজন্ম এই হারানো ঐতিহ্যগুলো চিনতে পারবে ।