বৃহঃ. মার্চ ২৮, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

11kড. সা’দত হুসাইন ।।  খোলা বাজার২৪, শনিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬: মোহাম্মদ তোয়াহার ‘স্মৃতিকথা’ পড়ছিলাম। তিনি তাঁর সারা জীবন, যার প্রথম কয় বছর বাদ দিলে পুরোটাই রাজনৈতিক জীবন, এর তথ্যবহুল বর্ণনা দিয়ে বইটি রচনা করেছেন।
খুব অল্প বয়স অর্থাৎ স্কুলজীবন থেকেই আমরা তোয়াহার নাম শুনেছি। তাঁর সম্পর্কে নানা গল্প-কাহিনী আমাদের কানে এসেছে। এর মূল কারণ হলো নোয়াখালী শহরের পাশের এলাকা থেকে তখন শত শত মাটি কাটার ‘বদলা’ (শ্রমিক) কাজ করতে চরাঞ্চলে যাচ্ছে। শহরের লোকজন তোয়াহা ‘বাঁন্ধ’ সম্পর্কে আলোচনা করছে। এ ‘বাঁন্ধ’ হয়ে গেলে বিপুল পরিমাণ জমি নদী থেকে জেগে উঠবে। আমাদের পাড়া অর্থাৎ ল’ইয়ার্স কলোনির প্রায় সব পরিবারের জমি নদীতে চলে গিয়েছিল। এসব জমি জেগে উঠলে আমরা সবাই উপকৃত হব। বাপ-দাদার আমলের জমি যা নদীগর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল তা আবার চাষাবাদের উপযোগী জমি হিসেবে নিজেদের মালিকানায় ফিরে আসবে এ আশায় পাড়ার মুরব্বিরা উচ্ছ্বসিত। তাঁদের মুখে তোয়াহার নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল।
কে এই তোয়াহা, তা ভালো করে বোঝার বয়স আমাদের হয়নি। তবে এ কথা বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি বড়সড় কেউ। আস্তে আস্তে জানতে পারলাম, তিনি একজন এমএলএ বা প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য। তাঁর নির্বাচনী এলাকা হচ্ছে রামগতি, যা তখনকার দিনে নোয়াখালী জেলা, বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার অংশ। নোয়াখালী সদর থেকে সড়কপথে রামগতি যাওয়া সম্ভব ছিল না। আসলে নোয়াখালী শহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল দক্ষিণে গেলেই মেঘনা ও তার শাখা নদী। এই নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছিল নোয়াখালী জেলার পুরনো শহর, জেলার সদর দপ্তর। এ নদী গ্রাস করেছিল জেলার হাজার হাজার পরিবারের বসতভিটা। ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয় বহু সচ্ছল পরিবার। মা-বাবার মুখে শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষরা নদীভাঙনের কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একাধিকবার স্থানান্তরিত হয়েছেন। তাঁদের মুখে একটি কথা প্রায়ই শুনতে পেতাম যে ঝড়ে ঘর ভাঙলে জিনিসপত্র ভাঙা অবস্থায় হলেও আশপাশে পড়ে থাকে, আগুনে পুড়লে অন্তত ঘরের ছাই পাওয়া যায়, নদীভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হলে কিছুই থাকে না, সবই নদীগর্ভে হারিয়ে যায়।
তোয়াহা ‘বাঁন্ধ’ সেই নদীভাঙা মানুষের আশা-ভরসা জাগিয়ে তুলেছে। মুরব্বিরা হাত তুলে তোয়াহা সাহেবের জন্য দোয়া করছেন। শহরের খুব কম লোকই তোয়াহা সাহেবকে দেখেছেন। তাঁরা তোয়াহা সাহেবের নাম শুনেছেন। নোয়াখালীজুড়ে তাঁর সম্পর্কে নানা গল্প রূপকথার মতো ডালপালা মেলতে শুরু করেছে।
১৯৬১ সালে ঢাকায় এসে তোয়াহা সাহেবের নামডাক তেমন শুনতে পাইনি। ১৯৬৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে (ইপসু) যোগ দিলাম। ইপসু তখনো দুই ভাগ হয়নি। সংগঠনটিতে কমিউনিস্ট পার্টির আছর ছিল লক্ষণীয়। এর ওপরের সারির নেতাদের মুখে বড় বড় কমিউনিস্ট নেতাদের নাম লেগে থাকত। সুযোগ পেলেই তাদের গল্পগাথা, বীরত্ব ও মহত্ত্বের কাহিনী আমাদের সিনিয়ররা সগর্ভে রসিয়ে রসিয়ে আমাদের শোনাতেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেসব কাহিনী শুনতাম। যে কয়জন কমিউনিস্ট নেতার নাম আমরা সবচেয়ে বেশি শুনতে পেতাম তাঁরা হলেন মণি সিংহ, খোকা রায়, কমরেড ফরহাদ, আবদুল মতিন ও আনোয়ার জাহিদ। কমরেড আবদুল মতিনকে বলা হতো ভাষা মতিন। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের আলাপ-আলোচনায় আমাদের মনে এ রকম একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল, কমরেড মতিনের একক নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণাটি অপরিবর্তিত রয়েছে। তাঁর পাশাপাশি যে নামটি শোনা যায় তা হচ্ছে গাজীউল হক।
বয়স বাড়লে নানা তথ্য সংগ্রহ করে বুঝতে পেরেছিলাম যে ভাষা আন্দোলনে আরো কয়েকজন ছাত্র ও যুবনেতা সম্মিলিতভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের কারো অবদান খাটো করে দেখা সমীচীন হবে না। মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ ছিলেন তাঁদের অগ্রভাগে। শোনা যায়, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, জিন্নাহর এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তোয়াহা সাহেবই প্রথম প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘নো-নো’। তোয়াহা সাহেবের স্মৃতিকথায় ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। তিনি ছিলেন ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি। ভাষা আন্দোলনসংক্রান্ত বহু ছাত্রসভা তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র সাধারণের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রায় সবার ওপরে। তথ্য সংগ্রহ করে জেনেছি তাঁর নিষ্ঠা, সাহস, সততা, কঠোর পরিশ্রম, মানুষের মধ্যে সহজে মিশে গিয়ে তাদের মন জয় করার ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। যাঁরা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন তাঁরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
অথচ জাতীয় পর্যায়ে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল না। তিনি যে উচ্চতার (ঝঃধঃঁৎব) রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, জাতীয় পর্যায়ে সে উচ্চতায় তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়েছিল কি না তা নিয়ে যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যাঁদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা ছিল, তাঁর সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যক্তিগত মোহনীয় আকর্ষণে যাঁরা তাঁর অনুরক্ত সহচর ছিলেন তাঁরা অনেকেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর চেয়ে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিশাল হরফে তাঁদের নাম লেখা থাকবে। সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রতি সমর্পিত প্রাণ মোহাম্মদ তোয়াহা তাঁর কর্মনিষ্ঠায় প্রায় সব সহকর্মী কমরেডকে ছাড়িয়ে গেলেও প্রচারবিমুখ স্বভাবের কারণে জনসাধারণ্যে ব্যাপক পরিচিতি পাননি। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মার সম্পর্ক। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন হরিহর আত্মা। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও তাঁদের অনেক মিল ছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান কাজে লাগিয়ে তিনি কোনো সুবিধা নিতে চেষ্টা করেননি। নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসে অটল থেকে পার্টির পথে চলাই ছিল তাঁর কাছে পরম আনন্দের। নিজের জন্য আলাদা অবস্থান তৈরির চিন্তা তাঁর মনে আসেনি।
এখানে রাজনৈতিক নেতাদের আদর্শিক বিশ্বাস, তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ ও রাজনীতিতে যোগদানের পেছনে তাঁদের মূল উদ্দেশ্য আলোচনায় চলে আসে। আমরা সাধারণভাবে জানি, রাজনীতিতে নীতিনিষ্ঠ, ত্যাগী নেতা যেমন রয়েছেন, তেমনি এ অঙ্গনে ধান্দাবাজ স্বার্থান্বেষী নেতারও অভাব নেই। শেষোক্ত নেতাদের মধ্যে অনেকেই আবার দেশবরেণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। দেশের মানুষ শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় তাঁদের সিক্ত করে। তাঁরাও জনতার নামে মূর্ছা যান, জনতার দুঃখে কেঁদে বুক ভাসান, জনতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তোলেন। ভাবসাব এমন দেখান, যেন জনতার জন্যই তাঁরা বাঁচেন-মরেন। তোয়াহা সাহেব তাঁর স্মৃতিকথায় অনেক রথী-মহারথীর কাহিনী সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ত্যাগী ও সৎ নেতারা যেমন জনগণের শ্রদ্ধার পাত্র, পদ-পদবি ও ক্ষমতালোভী নেতাদের প্রতিও তাদের আনুগত্য-ভালোবাসার কমতি নেই। সাধারণ মনে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয় যে এ অবস্থায় রাজনীতিতে ত্যাগী ও নির্লোভ নেতা হওয়ার আলাদা কোনো গুরুত্ব আছে কি না।
ক্ষমতায় আরোহণ বা ক্ষমতার আশপাশে থাকার জন্য বরেণ্য রাজনৈতিক নেতাদের দৌড়ঝাঁপ কী রকম ন্যক্কারজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা জেনে দুঃখের চেয়ে বেশি করুণার উদ্রেক হয়। এ ব্যাপারে নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তাঁরা ষড়যন্ত্রকারী একনায়কের সঙ্গে হাত মেলাতে, তাঁদের গলায় মালা পরাতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ক্ষমতার লোভে বিশাল মাপের নেতারা বারবার নিজেদের অবস্থান বদলেছেন। এমনকি ক্ষমতায় যাওয়ার আগের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছেন। সে জন্য তাঁদের রাজনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়নি, প্রভাব কমেনি। তাঁদের অনুগত অনুসারীরা বুঝে হোক, না বুঝে হোক তাঁদের দলেই ছিল, তাঁদের সর্বশেষ অবস্থান নানা অপযুক্তি ও কুতর্ক দিয়ে সমর্থন করেছে। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার, ‘নেতা যা-ই করুন, যেখানেই থাকুন না কেন তাঁর পেছনে থাকলে আমাদের উপকার হবে। তিনি আমাদের স্বার্থ দেখবেন। অতএব নিজ স্বার্থেই নেতাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে হবে। তাঁকে ত্যাগ করলে আমাদের স্বার্থহানি ঘটবে। কুলদীপ নায়ারের বইয়ে উপমহাদেশীয় নেতাদের, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের এ ধরনের চারিত্রিক বৈপরীত্যের নানা কাহিনী বিধৃত হয়েছে। এতে তাঁদের রাজনৈতিক মর্যাদার হেরফের হয়নি। তাঁরা তাঁদের জায়গায়ই রয়ে গেছেন। দেশের মানুষ কয়েক দিন পর এসব কথা ভুলে গেছে অথবা নিজ গুণে নিজ উদ্যোগে এ ধরনের বিপরীতধর্মী অবস্থানের মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করে তার মধ্যে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করেছে।
১৯৪৭ সালে বাংলা দ্বিভাগকরণ নেতাদের চারিত্রিক দ্বৈততার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ করা হলো তখন বাংলা তথা উপমহাদেশের একশ্রেণির নেতানেত্রী, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজপতির দুঃখ-আহাজারিতে আকাশ-বাতাস মথিত হয়েছিল। জোর গলায় সোর তুলে তাঁরা বলেছিলেন, অখণ্ড বাংলা তাঁদের প্রাণ, তাঁদের সত্তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে তা মিশে আছে। বাংলা ভাগ করা মানে তাদের দেহ দ্বিখণ্ডিত করা, তাদের আত্মার এক অংশকে কেড়ে নেওয়া। ৪০ বছর পর দেখা গেল বাংলাকে দুই ভাগ করার জন্য তাঁরা আদাজল খেয়ে লেগেছেন। কারণ বাংলাকে অখণ্ডিত রেখে দেশ বিভাজন হলে অখণ্ড বাংলায় তাঁদের আধিপত্য থাকে না। অতএব এক কোপে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করো। তাতেই স্বার্থ, তাতেই স্বস্তি। বাংলা ভাগ হয়ে গেল। নেতারা তাদের পদ-পদবি, মন্ত্রিত্ব সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। প্রায় সব নেতা উঁচুস্তরের রাষ্ট্রীয় আসনে সমাসীন হলেন। সাধারণ মানুষ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না। তারা স্লোগান বদলে নেতাদের পেছনে জয়ধ্বনি করল। ইতিহাসের পাতায় মন্ত্রী-মহামন্ত্রী হিসেবে নেতারা ঠাঁই করে নিলেন। যাঁরা আদর্শ আর নীতি আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলগহ্বরে হারিয়ে গেলেন। এখন গবেষণা করেও তাঁদের অনেকের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আলোচনার মুখ্য ইস্যু হচ্ছে, শুধু আদর্শবাদী ভালো মানুষ হয়ে রাজনীতির শীর্ষ স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব কি না। উত্তর হচ্ছে, প্রায় অসম্ভব। রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত; সে ক্ষমতা ব্যক্তির হতে পারে, আবার গোষ্ঠীরও হতে পারে। উঁচুমানের কৌশলী (ঝঃৎধঃবমরংঃ) ও অসাধারণ ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন দক্ষ সংগঠক না হলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে টিকে থাকা দুষ্কর হয়। পারিপার্শ্বিক বাতাবরণের সুযোগ নিয়ে অথবা পরিবেশ পরিকাঠামোকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারলে তবেই ক্ষমতার অঙ্গনে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করা সম্ভব হয়। যেকোনো বিচারে মোহাম্মদ তোয়াহা অতি উঁচু মানের ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর অনুসৃত কৌশল তেমন উৎকৃষ্ট মানের ছিল না। তিনি ত্যাগী ছিলেন। তবে তাঁর সেই ত্যাগ আর্কষণীয় ভূষণ হতে পারেনি। শত মানুষের মধ্যে তাঁকে উজ্জ্বলতম ব্যক্তি বলে মনে হয়নি। যাঁরা তাঁর কাছে ছিলেন তাঁরা তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন, কিন্তু সে গুণের ছটা সাধারণ্যে বিচ্ছুরিত হয়নি। হয়তো অসাধারণ আত্মমর্যাদা ও সুউচ্চ মূল্যবোধ খ্যাতির শৃঙ্গে ওঠার পথ আটকে রেখেছিল। ফলে তাঁর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন লোক বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকর কৌশল প্রয়োগ করে রাজনীতিতে অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছেন।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সব রাজনৈতিক নেতার জীবনের মূল লক্ষ্য নয়। এমনটি হওয়ার কথাও নয়। তবে বেশির ভাগ রাজনীতিক ক্ষমতায় যেতে চান। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতিক্রমধর্মী অসামান্য কৃতী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাদ দিলে ক্ষমতা থেকে সারা জীবন দূরে অবস্থানকারী রাজনীতিককে জনসাধারণ খুব একটা আমলে নেয় না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠান তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সামর্থ্যের ইঙ্গিতবাহক। এটি তার মর্যাদাকে পাকাপোক্ত করে। ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর ‘সাবেক’ হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে তার জন্য একটি বিশিষ্ট স্থান চিরস্থায়ী হয়, নতুন কর্মসূচি গ্রহণ বা বাস্তবায়নে ‘সাবেক’ পরিচয় বিশেষ সহায়ক হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হলে সামাজিক ক্ষমতায় তাকে শীর্ষে অবস্থান করতে হবে। অর্থাৎ ‘নন-রুলিং এলিট’ হিসেবে রাজনীতির শৃঙ্গে তাকে উঠতে হবে। তা না করে ‘পার্টি’র একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষায় জীবনপাত করলেও সাধারণ মানুষের কাছে তার গুরুত্ব থাকবে না। যাদের কল্যাণের জন্য তার এত শ্রম ও ত্যাগ, ধীরে ধীরে তারা দূরে সরে যাবে। তাকে সাধারণ মানুষ অক্ষম-অদক্ষ ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেবে। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলেও তার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে না। তার পেছনে সময় ব্যয় করতে তারা স্বস্তি বোধ করবে না। নেতৃত্ব টেকসই করতে একজন রাজনীতিককে হয় দু-একবার ক্ষমতায় যেতে হবে, উচ্চপদে অধিষ্ঠান করতে হবে অথবা ক্ষমতার বাইরের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করতে হবে। এ দুইয়ের কোনোটি না হলে ধুঁকে ধুঁকে হারিয়ে যেতে হবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান
[সংকলিত]