শুক্র. মার্চ ২৯, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার ২৪, শুক্রবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ঃ অভয়ারণ্য-যেখানে কোন ভয়, ডর বা বাধা থাকে না। আতংক-যেখানে সদা সর্বদা ভয়, ডর বা বাধা’র আশংকা বিরাজমান থাকে। আমাদের এই দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট অবলোকন করলেই বোঝা যাবে শিরোনাম ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ঃ অভয়ারণ্যের স্বর্গরাজ্য ও আতংক’।

৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটেছে দেশে এক অদ্ভূত-বিচিত্রময় ভোট। আর এ ভোটের রাজনীতি হয়েছে এক পক্ষের জন্য অভয়ারণ্যের স্বর্গরাজ্য আর অপর পক্ষের জন্য আতংক। জনগণ ভাবছে এ কাজে তদারকির ভূমিকা পালন করেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কার ইশারায় আর কোন প্রভূর মনোবাসনা পূরণের জন্য তদারকির ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছিলেন তাও একদিন প্রকাশ পাবে।

বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই দেখা যায় সরকারী পক্ষ (আওয়ামীলীগ) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় জনপ্রিয় বিরোধীপক্ষ (বিএনপি) কে মিথ্যা মামলা দিতে দিতে আর গ্রেফতার ও আদালতে হাজির করাতে করাতে বে-কায়দায় ফেলেছে কিছুটা হয়তো। পক্ষান্তরে সরকারী পক্ষ (আওয়ামীলীগ) ক্ষমতায় জেকে বসার নিমিত্তে নিজেদের সব মামলা তুলে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন প্রধান শেখ হাসিনাও বাদ যাননি। কেননা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন-ইয়াজউদ্দিন) এর সময় শেষে দেখা যায় আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হত্যামামলাসহ মোট ১৫ টি মামলা ছিল এবং দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল প্রায় ১৫ (পঁনের) হাজার কোটি টাকার। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ছিল আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনার তিন ভাগের এক ভাগ মামলা মাত্র ৫টি;ছিল না কোন হত্যা মামলা আর যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে তাতে অভিযোগ ছিল ২ কোটি টাকা অথচ এই টাকা তছরুপ-ই হয় নাই।। আওয়ামীলীগ সরকার আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হত্যামামলাসহ মোট ১৫ টি মামলার সবগুলোই মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তুলে নেন আর বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৫ টি মামলা প্রথমে সপ্তাহে সপ্তাহে ১ দিন করে পরে ৩ দিন এমনকি ৫ দিন করেও হাজিরা রেখে শুনানি শেষ করে ৫ বছরের সাজা দেন। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় সে মামলার জামিন তো দেননাই বরং সাজা দ্বিগুন করে দিয়েছেন অর্থাৎ ১০ বছর করে দিয়েছেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ বুঝতে পেরেছেন বিচারালয়ের বিচার কার ইশারায় বা জাদুমন্ত্রে চলে। জনগণের মনে এক নেত্রী হয়েছেন অজনপ্রিয় আর অপর নেত্রী হয়েছেন অর্জনপ্রিয়। জনগণ একজনকে দিয়েছেন ‘একক কর্তৃত্ববাদের শাসক’ আর অপরজনকে ‘গণতন্ত্রের মা’ উপাধি।

গুম, খুন, অপহরণ, দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন, ধর্ষণ, অনিরাপদ জীবন এসব পরিবেশের মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত হয় বাংলাদেশের জনগণের যাপিত জীবন। কেউ এসব বিষয়াদি নিয়ে সমালোচনা করলে তার উপর নেমে আসে নির্মমতা-হতে হয় তাকে গুম, খুন বা অপহরণের স্বীকার। সেই চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী থেকে শুরু যার শেষ আজও হয় নাই। কতো মায়ের আহাজারি, বাবা বা ভাইয়ের বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয় আর খোঁজাখুঁজি, কতো ছেলে-মেয়ের বুক চাপড়ানো কান্না, কত স্ত্রীর কষ্ট, জ¦ালা, ব্যাথা, অশ্রসিক্ত নয়নে হাহাকার বুকের অপেক্ষা.. …….. যেনো শেষ হয় না। এভাবেই আসে ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারীর নির্বাচন এবং অতি সম্প্রতি’র ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কি দেখা গেল? নির্বাচনের বহু আগে থেকেই আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক শুধু বিএনপি ও এর জোট নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, জেল ইত্যাদি। অপরদিকে আওয়ামীলীগ ও এর জোট নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাদাবাজি, সন্ত্রাসীর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নামে মামলা দেওয়া তো দুরের কথা বরং তাদের আরো নিরাপদ রাখে-যা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর স্বাধীন বাংলাদেশের এ যাবৎ কালের সর্বশ্রেষ্ঠ পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে ০৫ অক্টোবর ২০১৮ পর্যন্ত বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৯০ হাজার ৩৪০ টি+ (প্রায়) মামলা করেছে আওয়ামী সরকার আর এসব মামলার মোট আসামী সংখ্যা ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জন+ এবং হত্যা করা হয়েছে ১৫১২ জনকে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে;ডিসেম্বর মাসে দেখা গেল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেনো একের পর এক শুধু বিএনপি নেতা-কর্মীদেরই গ্রেফতার করে আর জেলখানায় ভরায়। বিএনপি নেতা-কর্মীদের দিয়ে জেলখানা পরিপূর্ণ। বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতারের পর মামলা না থাকলেও তাদের নামে দেওয়া হয় নতুন করে মামলা। ধানের শীষের প্রচার-প্রচারণা তো দুরের কথা, ধানের শীষের সমর্থক হলেই তাকে ধরো জেলে পুরো-এই ছিল যেনো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্ম। তাদের সংবিধানে এই কি ছিল নির্দেশনা। অথচ আওয়ামীলীগরা বিনা বাধায়-পুলিশি প্রহরায় প্রচার-প্রচারণা চালান আর ধানের শীষের সমর্থকরা পোষ্টার টানাতে গেলে বা প্রচারণা চালালে তাদের উপর আওয়ামীলীগরা পুলিশি প্রহরায় বা কোথাও পুলিশি সহযোগে হামলা চালায় বিএনপিদের উপর। আওয়ামীলীগ অপরাধ করলেও পুলিশ তাদের জন্য করে রেখেছে অভয়ারণ্য। শুধু অভয়ারণ্য নয়-অভয়ারণ্যের র্স্বগরাজ্য। আর বিনা অপরাধে বিএনপিদের জন্য পুলিশ করে রেখেছে সদা সর্বদা আতংক। এ আতংকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা কেউ ঘরে থাকতে পারেন না, পথে চলতে পারেন না, বাজারে যেতে পারেন না, প্রকাশ্যে আসতেই পারেন না। সাহস করে বের হয়ে আসলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর গুলি খেয়ে মরতে হয়-যার নাম দেওয়া হয় ক্রসফায়ার; নয়তোবা গুম ও অপদস্ত-অপহরণের স্বীকার হতে হয়। ধানের শীষ নেতা-কর্মী-সমর্থক-ভোটারদের প্রতি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর দুর্বীনিত ভয়-ভীতি, মামলা, গ্রেফতার, জেল-রিমান্ড এসবের মধ্যেই আসে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-নির্বাচনের দিন। যেখানে নির্বাচনের আগের রাতেই নাকি অনেক কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতীকে ছিল মেরে ভরে রাখে-এমন এক প্রতিবেদন বিবিসিতে শুনা যায়। আর অভিযোগ আছে ভোটের দিন আওয়ামীলীগদের সাথে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর যৌথ মহড়ায় কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্টদের ঢ়ুকতে তো দেওয়াই হয় নাই এবং ধানের শীষের কোন ভোটারদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এক মহিলা ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় আওয়ামীলীগ নেতারা তাকে গণধর্ষণ করেন-যা বিশ^বিবেককে নাড়া দেয়।

আর ভোটদানের পর অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর যে সব বিদেশী পর্যবেক্ষক সেদিন বলেছিলেন-নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে, তারা পরবর্তীতে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে জেনে-বুঝে পরে নিজ দেশে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন-বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষণ অনেকটাই ভূল বা মিশ্র ছিল-বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠ হয় নাই। আবার নির্বাচনের পর এটা খোলাসা হয়েছে যে, দেশীয় অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থার প্রধান ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি নেতারা যখন অভিযোগ নিয়ে ইসিতে যেতেন তখন বিএনপি নেতারা ইসি থেকে বের হয়ে আসার পর পরই আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা’র উপদেষ্টা এইচটি ইমাম যেতেন ইসিতে;আলাপ আলোচনা করতেন এবং বিএনপি যেসব অভিযোগ দিতেন তার উল্টো সুরে কথা বলতেন-যা পরে তাদের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেখা গেছে। তখন তারা কিন্তু ঐসব পর্যবেক্ষণ সংস্থার প্রধানদের বিষয়ে (আওয়ামীলীগ হওয়ায়) কোন প্রশ্ন তোলেন নি বরং বিএনপি যা অভিযোগ দিয়েছেন তার উল্টো করেছেন এবং ইসি বিএনপি’র অভিযোগগুলো সমাধান বা লংঘন করেন নাই।

……………..এতে বুঝা যায় ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, ধানের শীষের ভোটারদের প্রতি কি অমানবিক, ভয়-ভীতিমূলক ও বিরূপ পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করা হয়েছে। এভাবেই হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদের ভোট। আর ফলাফল…… সে তো সন্ধ্যার পরপরই দেখা গেল আওয়ামীলীগ-বিএনপির মধ্যে আকাশ-পাতালের চেয়েও বেশী পার্থক্য, অথচ জনমত এমন ছিল না।
নির্বাচনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল জয় হওয়ার জন্য আওয়ামীলীগরা ভোজ উৎযাপন না করলেও একটা বিশেষ বাহিনীদের মধ্যে কয়েকদিন ব্যাপী ভোজ উৎসব। যেনো নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নয় তারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছেন।
………..সার্বিকভাবে জনগণ দেখেছেন কিভাবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক একদল বা জোট অভয়ারণ্যের স্বর্গরাজ্য পেয়েছেন আর অপর দল বা জোট সদা সর্বদা আতংকের মধ্যে রয়েছিলেন এবং এখনও আছেন। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষপাতিত্বের জন্য আজ যেনো বাংলাদেশের রাজনীতি হয়েছে এক পক্ষের জন্য অভয়ারণ্যের স্বর্গরাজ্য আর অপরপক্ষের জন্য আতংক। জনগণ পক্ষপাতিত্বের অবসান চায়। জনগণ চায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বাক-ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান ভূমিকা পালন করুক।

মো: মিজানুর রহমান-লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।