শুক্র. মার্চ ২৯, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার ২৪,বৃহস্পতিবার ,০৯মে ২০১৯ঃ ৫২টি ভেজাল পণ্যের তালিকা দেখে গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। ভেজাল পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার চেয়ে করা রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এত ভেজাল! এ কী অবস্থা!!’ রূপচাঁদা, প্রাণ ও তীরের সয়াবিন তেলসহ অনেক নামি দামি ব্র্যান্ডের পণ্যও আছে দেখছি! প্রাণ, ফ্রেশের হলুদের গুঁড়াতেও ভেজাল? তাহলে আমরা কোথায় আছি? যেসব পণ্যের তালিকা দেখছি, তাতো ঘরে ঘরে মানুষ সচরাচর ব্যবহার করছে। কোনো কোম্পানিই তো বাদ নেই। অনেক বড় বড় কোম্পানির পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। অথচ তাদের পণ্য নিম্নমানের, ভেজাল? এ কী অবস্থা!

আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) পরীক্ষায় প্রমাণিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য জব্দ এবং এসব পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার ও উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে রিটের শুনানিকালে আদালত এসব কথা বলেন।

আদালত সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, তারা বড় বড় অফিস নিয়ে বসে আছে। তাদের কাজটা কী? তারা দায়িত্ব পালন করতে না পারলে অফিস ছেড়ে দিক। বিএসটিআই একটি বিশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য ধরা পড়ল। এরপর শুধু শোকজ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ? তাদের ওই সব পণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

আদালত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, আইনে তাদের সব দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কী করছে? তারা কাজ করতে না পারলে অফিস ছেড়ে দিক। আমরা কেন এসব দেখতে যাব?

আদালত বলেন, প্রতি সপ্তাহে একটি করে জনস্বার্থমূলক বিষয় আমাদের সামনে আসছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব সরকারের। কোথাও ভেজাল হচ্ছে, কারাগারে মানুষ পুড়ে যাচ্ছে, মাংসে ভেজাল, ভেজাল পানি, ভেজাল খাদ্য, বিভিন্ন ভেজাল পণ্যে বাজার ভরে গেছে। এসব দেখে কি আমরা বসে থাকব? তা হয় না। এসব আমরা দেখলে আমাদের সমালোচনা করা হয়।

আদালত বলেন, রোজা আসলেই বিএসটিআই পণ্যের মান পরীক্ষা করে। রোজার সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? তারা (বিএসটিআই) অন্য সময় কী করে?

বিএসটিআইয়ের চিহ্নিত ৫২টি পণ্যের তালিকা দেখে আদালত বলেন, এসব পণ্য বাজারে আছে কি না তা তাদের (বিএসটিআই) কাছ থেকে জানা দরকার।

৫২টি ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য জব্দ ও উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে বৃহস্পতিবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।

শুনানির শুরুতে রিটকারী আইনজীবী আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি আপনি (বিচারপতিগণ) আমাদের শিশুরা এসব ভেজাল খাদ্যপণ্য গ্রহণ করছে। বিএসটিআই সংবাদ সম্মেলন করে এসব ভেজাল পণ্যের তথ্য তুলে ধরলেও তারা পণ্যগুলো এখনো জব্দ করেনি।

তখন আদালত বলেন, এসবের মধ্যে কমন পণ্য কী কী রয়েছে? রূপচাঁদার ও তীরের সরিষার তেলসহ অনেক নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্যও আছে দেখছি! প্রাণ, ফ্রেশের হলুদের গুঁড়াতেও ভেজাল? তাহলে আমরা কোথায় আছি?

এ পর্যায়ে রিটকারী আইনজীবী বলেন, আমাদের শিশুরাও এসব পণ্য গ্রহণ করছে। আমরা তাহলে কী করব?

আদালত বলেন, ভেজাল পণ্য রোধ করা বা জব্দ করার কাজ সরকারের। এগুলো তাদের দেখা উচিত। আমরা সাধারণ মানুষের মামলা দেখব, নাকি এসব মামলা দেখব? ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কোথায়?

তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান শুনানির জন্য দাঁড়ালে আদালত তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, কী ব্যাপার? প্রতিদিন এসব ভেজাল পণ্য নিয়ে কোর্টে মামলা আসছে। সরকার কী করছে? বিশেষ ক্ষমতা আইনে এসব বিষয়ে সাজার বিধান নেই?

জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে।

আদালত বলেন, বিএসটিআইয়ের তালিকায় রূপচাঁদা, তীরের মতো ব্র্যান্ডের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বিএসটিআই শুধু শোকজ করেছে। ভেজাল নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে পণ্যগুলো তুলে নেওয়া উচিত ছিল। এটাই নিয়ম। আমরা কি দেশ চালাই? কোর্ট কি দেশ চালায়? এটা সরকারের কাজ। তবু এসব কীভাবে হয়? অথচ আমরা (আদালত) আদেশ দেই আর আমাদের সেই আদেশের সমালোচনা করা হয়। তাহলে এ মামলায় কাদের তলব করা যায়?

রিটকারী আইনজীবী আদালতকে বলেন, বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালককে তলব করা যেতে পারে। আর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ডেপুটি পদস্থ কাউকে তলব করা যেতে পারে।

এরপর আদালত বলেন, বিএসটিআই ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উপপরিচালকের নিচে নয় এমন পদস্থ কর্মকর্তাদের আসতে বলুন। এভাবে চলা যায় না। এই ব্র্যান্ডগুলো দেশে ছাড়াও বিদেশে পণ্য রপ্তানি করছে। প্রাণ লাচ্ছা সেমাইতেও ভেজাল। তারা (বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ) কী করছে? দেশে ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন আমাদের (হাইকোর্টে) কাছে আসতে হবে? সেখানে কেন যাওয়া হয় না? ঠিক আছে। ওই দুই কর্মকর্তাকে তলব করা হোক এবং আমরা এ বিষয়ে আগামী রোববার (১২ মে) মামলাটি আদেশের জন্য রাখছি।

বিএসটিআই ঘোষিত ভেজাল পণ্যগুলো হলো—সিটি অয়েলের তীর সরিষার তেল, গ্রিন ব্লিচিংয়ের সরিষার তেল, শবনম ভেজিটেবল অয়েলের পুষ্টি সরিষার তেল, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা সরিষার তেল, কাশেম ফুডের চিপস, আরা ফুডের ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফির ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজান ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্নিং ডিউয়ের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকান ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, আরার ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দিঘী ড্রিংকিং ওয়াটার, প্রাণের লাচ্ছা সেমাই, ডুডল নুডলস,শান্ত ফুডের সফট ড্রিংক পাউডার, জাহাঙ্গীর ফুড সফট ড্রিংক পাউডার, ড্যানিশের হলুদের গুঁড়া, প্রাণের হলুদ গুঁড়া,ফ্রেশের হলুদ গুঁড়া, এসিআইর ধনিয়ার গুঁড়া, প্রাণের কারি পাউডার, ড্যানিশের কারি পাউডার, বনলতার ঘি,পিওর হাটহাজারী মরিচ গুঁড়া, মিষ্টিমেলা লাচ্ছা সেমাই, মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, মিঠাইর লাচ্ছা সেমাই, ওয়েল ফুডের লাচ্ছা সেমাই, এসিআইর আয়োডিনযুক্ত লবণ, মোল্লা সল্টের আয়োডিনযুক্ত লবণ, কিং-এর ময়দা, রূপসার দই, মক্কার চানাচুর, মেহেদীর বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর স্পেশাল ঘি, নিশিতা ফুডসের সুজি, মঞ্জিলের হলুদ গুঁড়া, মধুমতির আয়োডিনযুক্ত লবণ, সান ফুডের হলুদ গুঁড়া, গ্রিন লেনের মধু, কিরণের লাচ্ছা সেমাই, ডলফিনের মরিচের গুঁড়া, ডলফিনের হলুদের গুঁড়া, সূর্যের মরিচের গুঁড়া, জেদ্দার লাচ্ছা সেমাই, অমৃতের লাচ্ছা সেমাই, দাদা সুপারের আয়োডিনযুক্ত লবণ, মদীনার আয়োডিনযুক্ত লবণ, নুরের আয়োডিনযুক্ত লবণ।

কনসাস কনজ্যুমার সোসাইটির পক্ষে ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান জনস্বার্থে রিট আবেদনটি দায়ের করেন।

এর আগে গত ৬ মে বিএসটিআই কর্তৃক বাজারে এসব পণ্যে ভেজাল ধরা পড়ার পরও জব্দ না করা, সেগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা না নেওয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দুই মন্ত্রণালয়ের সচিব ও তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে আইনি নোটিশ পাঠান ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস)।

ওইসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো কেন জব্দ করা হবে না বা বাজার থেকে কেন প্রত্যাহার করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মহাপরিচালক (ডিজি), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতি নোটিশটি পাঠানো হয়। নোটিশের পরও ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ রিট আবেদন করা হয়।

গত ৩ মে ও ৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএসটিআই সম্প্রতি ২৭ ধরনের ৪০৬টি খাদ্য পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি পণ্য নিম্নমানের ও ভেজাল রয়েছে। গত ২ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের এ রিপোর্ট প্রকাশ করে বিএসটিআই।

গত ৩ মে ও ৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএসটিআই সম্প্রতি ২৭ ধরনের ৪০৬টি খাদ্য পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে ৫২টি প্রতিষ্ঠানের পণ্য নিম্ন মানের ও ভেজাল রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের এ রিপোর্ট প্রকাশ করে বিএসটিআই। কিন্তু সেসব পণ্য জব্দ বা উৎপাদন বন্ধে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় হাইকোর্টে ওই রিট দায়ের করা হয়।