শুক্র. এপ্রি ১৯, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার ২৪,রবিবার, ৩০জুন,২০১৯ঃ নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হলে বাজেটের ভালো-মন্দ ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি নিয়ে সমাজের চারপাশে নানা ধরনের কথা শোনা যায়। কিন্তু আমি প্রাথমিকভাবে যে কথাটি ভাবি সেটা হচ্ছে, বাজেটের একটা ‘ইকোনমিক ফিলোসফি’ আছে, আমাদের এখানে সেসবের কোনো ছাপ দেখা যায় না। সরকারের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাজেটে একটা রূপরেখা প্রকাশ করা হবে, তেমন আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখতে পাই না।

বাজেট নিয়ে বড় আকারে যেটা সামনে আসে—এবারের বাজেট ব্যবসাবান্ধব অথবা ব্যবসাবান্ধব নয়। তার মানে বাজেটকে বড় আকারের যে ভাবনা থেকে পৃথক বা এককভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেখানে ব্যবসায়ীদের কথাই বিশেষভাবে ভাবা হয়। এটা নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনাও আছে। পক্ষে ও বিপক্ষে মতও আছে। কিন্তু যাঁরা বাজেট প্রণয়ন করেন, ঘোষণা ও উপস্থাপন করেন, তাঁরা হয়তো সার্বিকভাবে ব্যবসাবান্ধব বাজেটের একটা ভাবনা মাথায় রাখেন। ফলে সমাজে আর্থ-সামাজিকভাবে যাঁরা অগ্রসর ও সামর্থ্যবান তাঁদের জন্যই বাজেটটা উপকারী বলে প্রতীয়মান হয়। যাঁরা সামর্থ্যবান, তাঁদেরই যেন প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টাটা বেশি থাকে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সংসদে বাজেট পেশ হয়। বাজেটের ভালো-মন্দ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনার সুযোগ থাকে না। সরাসরি বলতে গেলে বাজেটে সাধারণের কোনো অংশগ্রহণের সুযোগ বা মত নেই। বাজেটটা কাদের জন্য? সাধারণ মানুষ কি বাজেটের আওতার বাইরে? বাজেটের ভালো-মন্দ বা সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো মতামত নেওয়া হয় না। সাধারণ মানুষ হয়তো বাজেটের বড় ও বিশদ বিষয়গুলো বুঝতে পারবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কী—সেটা বাস্তবায়ন হোক বা না হোক, তাদের মতটা জানানোর কোনো সুুযোগ নেই বা সরকার সেটা জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না। এর ফলে যা হয়, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বাজেট ঘোষিত হয়, যাপিত জীবনে নতুন নতুন কিছু নির্দেশনা এসে হাজির হয়, সাধারণ মানুষ তা দেখে এবং মেনে নেয়। মানতে হয় তাদের।

পৃথিবীর কোথাও এত কম সময়ের মধ্যে বাজেট ঘোষণা ও পাস হয় বলে আমার জানা নেই। আমাদের এখানে যেহেতু একটা বাধ্যবাধকতা থাকে যে ৩০ জুনের মধ্যে বাজেটটা চূড়ান্তভাবে গৃহীত বা পাস হতে হবে। ফলে এতে কতগুলো ব্যাপার থাকে। বাজেট নিয়ে সেভাবে আলোচনা ও সমালোচনার সুযোগ কমই থাকে। হয়তো থাকেও না। সাধারণ মানুষের কোনো মতামত দেওয়ার সুযোগ এখানে থাকে না। যদিও শেষ পর্যন্ত দু-একটি বিষয়ে সামান্য কিছু কমবেশি হয়। কিন্তু সেই অর্থে খসড়া বাজেটের সঙ্গে চূড়ান্ত বাজেটের কোনো পার্থক্য খুব একটা থাকে না।

এবারের বাজেটে দু-একটি বিষয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের উেস কর বা সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমবেশি করা, সিমেন্ট এবং আরো দু-একটি প্রয়োজনীয় জিনিসে করারোপ বিষয়ে। এতে নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এটা অনেকে পছন্দও করেননি। এমন কোনো বিষয় সামনে আনা উচিত নয়, যেটা নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র সমালোচনা বা অসন্তোষ তৈরি হতে পরে। এ বিষয়ে আমি আমার কথা বলতে পারি—আমি একটি বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলাম। চাকরি থেকে অবসরের পর আমি যে টাকা পেয়েছিলাম, তার কিছুটা বাড়ির কাজে লাগিয়েছি, কিছুটা সঞ্চয়পত্রে রেখেছি। এখন তো আমার মতো মানুষের বয়স হয়েছে। আমরা সেভাবে নতুন করে কোনো ব্যবসায় করতে পারব না। সেই ক্যাপিটালও নেই। সঞ্চয়পত্র থেকে যে সুবিধাটা পাওয়া যায়, সেটার ওপর নির্ভর করতে হয়। এখন এই সামান্য সঞ্চয়পত্রে যদি সুদ কমানো হয় বা এর উেস কর বসানো হয়, বিষয়টা নিয়ে চিন্তা আসে। সরকার তাহলে সঞ্চয়পত্রকে কিভাবে দেখে?

কোনো একটি খাতের পতন ঠেকাতে অন্য আরেকটি ছোট খাতকে দাবিয়ে রেখে বা চাপে ফেলে বয়স্ক মানুষদের কোণঠাসা করার কোনো কারণ তো নেই। এটা ঠিকও নয়। সঞ্চয়পত্রে কারা টাকা জমা রাখে এবং কেন রাখে—এটাও সরকারের ভাবা উচিত ছিল বলে মনে করি। আমার ধারণা, বিশেষ কোনো মহল থেকে প্রভাবিত হয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরেকটি বিষয় হলো, আমার একটি টিন নম্বর আছে। সেটা স্বাভাবিক নিয়মে হতেই পারে। কিন্তু আমার বাসার যে কাজের মেয়েটা, তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে পরামর্শ করলাম, মেয়েটার জন্য কিছু সঞ্চয়পত্র কিনে রাখি। পরে তার বিয়ের জন্য কাজে লাগবে। এখন তারও যদি টিন নম্বর লাগে, তাহলে বিষয়টা কেমন হয়? সঞ্চয়পত্রের উেস কর বা সুদের হার কমানোর বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটি কথাই মনে হলো—বাজেটে এমন কোনো প্রস্তাব কেন তোলা হয়, যেটা নিয়ে সাধারণের মাঝে সমালোচনা হয়? আমরা তো ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারি না। বাসার কাছে তেমন কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। শুধু চিকিৎসা বাবদ প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা বেরিয়ে যায়।

সাধারণ মানুষ তো আর বাজেটের বিস্তারিত বা ভালো-মন্দ বোঝে না বা ভাবেও না। তবুও বাজেটের প্রভাব সবাইকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু আমরা যারা বাজেটটা বুঝি এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি, সেটা নিয়েও দুঃখ আছে। আমরা যারা সুধী নাগরিক বা সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের দাবি করি, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করি। বাজেটের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলি। সেসব কথা তো সংসদে বা সরকারের কাছে পৌঁছায় না। পৌঁছায় না, তার কারণ হয়তো আমাদের ফোরাম নেই। যাদের ফোরাম আছে, তাদের কথা নিশ্চয়ই সরকারের কাছে পৌঁছায়। এ কারণে বাজেট নিয়ে কোনো শুনানির ব্যবস্থাও নেই। ফলে বারবারই কথাটি বলতে হচ্ছে যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পৃক্তি নেই। কেন এবং কত শতাংশ কর কাটা হয়—কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু করটা ঠিকমতো দিতে হবে। এই অবস্থা আর কি।

এবারের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট নিয়ে যেটা দেখতে পেলাম, তা গতানুগতিকই। শিক্ষা খাতে তো বাজেট কম বরাবরের মতো। স্বাস্থ্য খাতে আরো কম। এখন সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে উন্নয়ন খাতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ সে তুলনায় বিটিভির বরাদ্দ ১৮ বা ২০ শতাংশ বেশি। আমাদের এখানে উন্নয়নের দরকার আছে। উন্নয়ন না হলে জনবলকে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানোও মুশকিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, উন্নয়নের যে ধরন তা পরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত নয়। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হয় না। আবার কোন কাজটি আগে করতে হবে কোনটি পরে—সে বিষয়ে ভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছু ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। এসব কারণেই বলছি যে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্তি বাজেটে নেই। যারা বাজেটটা বোঝে, তাদেরও সঙ্গে রাখা হয় না। তাদের কথা ও আলোচনা শোনার ব্যবস্থাও দেখা যায় না। সাধারণের বিবেচনা বাজেটে রাখতে হবে, এমন নয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটি এখানে দেখা যায় না।

আবার মেগা প্রজেক্টগুলো কেন করা হচ্ছে—সবগুলো থেকেই যে সরাসরি উপকার পাওয়া যাবে, এমন নয়। এর থেকে সুবিধা কতটা আসবে, কখন কাজ শেষ হবে, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হয় না কেন, দেরিই বা হচ্ছে কেন, খরচ আরো বেড়ে যাচ্ছে কেন? এসব নিয়ে কোনো জবাবদিহি নেই।

বাজেটে নির্দেশিত নিয়ম অনুযায়ী মানুষ কতটুকু কর দিচ্ছে, সেই তুলনায় কতটা সুবিধা পাচ্ছে, সে বিষয়েও কোনো পরিষ্কার নির্দেশিকা বা জবাবদিহির সুযোগ নেই।

বাজেটটাকে যদি মানবিকভাবে ভাবা যেত এবং সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া যেত—সাধারণের মতের ওপরই বাজেট নির্ভর করবে এমন  নয়, কিন্তু সাধারণের মতামতের কিছুটা বাজেটে প্রতিফলিত হলে বাজেট আরো বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারত বলে মনে হয়। নিয়ম অনুসারে প্রতিবছরের মতো বাজেট ঘোষিত হলো, কিছু নতুন নিয়ম আরোপ করা হলো, কিছু খাতে কর বাড়ানো হলো—জনগণ তা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মেনে তাতে অংশীদার হলো—এটা বদলাতে পারলে বাজেট আরো ফলপ্রসূ হতে পারে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা