শুক্র. মার্চ ২৯, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার ২৪,সোমবার,০৫ আগস্ট ,২০১৯ঃ  রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুদীপ রঞ্জন দেব ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। গত বৃহস্পতিবার জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। জ্বর নিয়েও ওইদিন তিনি হাসপাতালের রোগীর সেবা নিশ্চিত করেন। পরদিন শুক্রবার থেকে তার শরীরের পরিস্থিতি গুরুতর হতে শুরু করে। শনিবার রক্ত পরীক্ষার পর জানতে পারেন, তিনিও ডেঙ্গু আক্রান্ত। এর পর থেকে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। ডা. সুদীপ রঞ্জন দেব সমকালকে জানান, তার বিভাগের আরও তিনজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন নারী চিকিৎসকের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। ওই চিকিৎসক মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। কয়েকবার রক্তের প্লাটিলেট দেওয়া হয়েছে। এর পরও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাকে নিয়ে সহকর্মীরাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

জানা যায়, সুদীপ রঞ্জনের মতো মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আরও আট চিকিৎসক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। একই হাসপাতালের ২৭ জন নার্সও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর মিলেছে। এ ছাড়া রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এক চিকিৎসক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ছয় চিকিৎসক এবং তিনজন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পাঁচজন চিকিৎসক ও এক নার্সের মৃত্যু হয়েছে। শুধু চিকিৎসক নার্সই নন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পর্যালোচনায়ও চাকরিজীবীদের ঝুঁকিতে থাকার তথ্য উঠে এসেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত দুই হাজার ৮৮৬ রোগীর মধ্যে পেশাভিত্তিক পর্যালোচনা করে সংস্থাটি বলছে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সবচেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

আইইডিসিআরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৮৬৪ জন, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৬০৭ জন, ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ২৭৪ জন, ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ১৩১ জন এবং ৫৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী ৬১ জন রয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা এক হাজার ৯৩৭ জন। এ হিসাবে চাকরিজীবীরা ৬৭ দশমিক ১১ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সমকালকে বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী আছেন। তবে এসব শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফুলটাইম কিংবা পার্টটাইম চাকরি করেন। এ ছাড়া ২৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী ব্যক্তিরা চাকরি ও ব্যবসা করেন। সুতরাং এই পর্যালোচনা থেকে বলা যায়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ব্যক্তিরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মস্থলকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মশা থেকে সুরক্ষার জন্য পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, কর্মস্থলকে সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। এজন্য জুতা-মোজা ও ফুলহাতার শার্ট ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে মশা প্রতিরোধী অ্যারোসলসহ অন্যান্য সামগ্রী অবস্থানরত কক্ষে ব্যবহার, কক্ষের পরিবেশ সর্বদা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, কক্ষের আশপাশের ফুলের টব সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। দিন-রাতের যে কোনো সময় ঘুমাতে গেলে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।

আইসিডিডিআর’বির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, অতিঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এডিস মশার বিস্তার দেখা যাচ্ছে। সে হিসেবে কর্মস্থলেও অনেক মানুষের আনাগোনা থাকে। সুতরাং সেখানে এই মশার বিস্তার ঘটতে পারে। তবে যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেসব হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য রোগীও অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছেন। কারণ ডেঙ্গুবাহিত রোগীকে কোনো মশা কামড় দিলে সেই মশা ওই ভাইরাস বহন করবে। আবার ওই মশা অন্যজনকে কামড় দিলে সেই ব্যক্তিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন। সুতরাং হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীকে পৃথক করতে হবে। এজন্য তাদের মশারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্নিষ্টদের ফুলহাতার শার্ট, প্যান্ট ও জুতা-মোজা ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতাল ও এর আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তাহলে এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে।

আক্রান্ত চিকিৎসক ও নার্স :মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসকরা হলেন- মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুদীপ রঞ্জন দেব, কনসালট্যান্ট রেহেনুমা পারভীন ও নাজিম আল আজাদ এবং মেডিকেল অফিসার ডা. কামরুল ইসলাম, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. তাপস চন্দ্র, সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. ওয়াসি উদ্দিন আহমেদ ও মেডিকেল অফিসার ডা. তাহেরা সুলতানা, ডা. হাসনাত আল মতিন এবং ডা. পারভীন সুলতানা। ডেঙ্গু আক্রান্ত একই হাসপাতালের ২৭ জন নার্স হলেন- অঞ্জু শিকদার, রাবেয়া আক্তার, শাহিনুর আক্তার, সমাপ্তি হালদার, খালেদা আক্তার, আমাতুন আজিমা, পারভীন আক্তার, ইতি অধিকারী, রুমানা হক, আতিকা আক্তার, মুন্নি খানম, রোকসানা আক্তার, রুমেনা আক্তার, সুচিত্রা বৌদ্ধ, মমতা বেগম, কাঞ্চনা হালদার, সাবিহা সুলতানা, রোকনুজ্জামান, মনিকা পেরেরা, শারমিনা সুলতানা, রিতা বল, সামলা আক্তার, ইশরাত জাহান, ইফতে আরা, নুপুর আক্তার ও ফাতেমা আক্তার। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দুই নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। তারা হলেন- মিনারা বেগম ও শাহনাজ আক্তার।

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. খায়রুল আলম জানান, চিকিৎসক ও নার্সরা জুলাই মাসের বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ওই রোগীদের কামড় দেওয়া কোনো মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে চিকিৎসক ও নার্সরা আক্রান্ত হতে পারেন। আবার বাসাবাড়ি থেকেও কেউ কেউ আক্রান্ত হতে পারেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. ফরহাদুল আলমও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। আরও দু’জন চিকিৎসক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ূয়া। তিনি বলেন, চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে যারা ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন, তাদের এই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। হাসপাতালে ভর্তি সব রোগীকে মশারির আওতায় আনা যাচ্ছে না। কারণ মশারি দেওয়া হলে দেখা গেছে, তা টানানোর স্ট্যান্ড নেই। আবার সব থাকলেও দেখা যায়, রোগী সব সময় মশারির মধ্যে থাকে না। কারণ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে মশারি টানিয়ে থাকা সম্ভব নয়। এ কারণে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য বিভাগে ভর্তি থাকা রোগীদেরও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেন, তার হাসপাতালে ছয়জন চিকিৎসক ও দু’জন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। তবে হাসপাতাল নাকি বাসাবাড়ি থেকে তারা আক্রান্ত হয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। কারণ হাসপাতালে সার্বক্ষণিক স্প্রে করা হয়। তাই ঝুঁকি থাকার কথা নয়।

চিকিৎসক ও নার্সের মৃত্যু :ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে পাঁচজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে বলে কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন। তবে তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৩ জুলাই রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় ডা. নিহার নাহিদ দিপু নামে এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। তিনি উত্তরার কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২১ জুলাই রাতে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শাহাদৎ হোসেন হাজরার মৃত্যু হয়। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর হবিগঞ্জ থেকে ওই দিনই তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। ২৫ জুলাই রাজধানীর আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তানিয়া সুলতানা নামে এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন। ২২ জুলাই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে রাজধানীর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসি সমাদ্দার নামে এক নার্সের মৃত্যু হয়। তিনি জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, কর্মস্থলে ঝুঁকির বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতালের স্টাফরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এই ঝুঁকি নিয়েও তারা সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন। এমনকি আসন্ন ঈদে সবাই যখন পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবেন, চিকিসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। সুতরাং আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এজন্য সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।