খোলা বাজার২৪,বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ ২০১৬:হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক এবং সংশ্লিষ্ট তিন ব্যাংকের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- তা খতিয়ে দেখে ‘প্রয়োজনে’ মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নামে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) মেসেজিং সিস্টেমে যাওয়া ‘ভুয়া’ অনুরোধ পাওয়ার পর ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার দুটি ব্যাংকে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মানা হয়েছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে আজমালুল হক কিউসিকে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বুধবার বলেন, “সংশ্লিষ্ট তিন ব্যাংক স্ব স্ব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কী না- সেটি যাচাইয়ে কাজ করবেন আজমালুল হক কিউসি। এক্ষেত্রে যদি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হয়- তাও তিনি নেবেন।”
রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়, যাতে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্তব্যে অবহেলা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ এবং সরকার গঠিত তদন্ত কমিটিও কার কোথায় দায় তা খতিয়ে দেখছে।
অবশ্য চুরির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরপরই ফেডারেল রিজার্ভের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ ঘটনা তাদের নিরাপত্তা ত্রুটির কারণে ঘটেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধ পাওয়ার পর নিয়ম মেনেই তারা ‘যথাযথ’ পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইতিহাসের অন্যতম বড় এই রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ৪ ফেব্র“য়ারি ঘটলেও তা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে প্রায় এক মাস পর ফিলিপিন্সের তদন্তকারীদের বরাতে দেশটির একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে।
এরপর ফিলিপিন্সের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন তথ্য। জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে একশ কোটি ডলার সরাতে মোট ৩৫টি অনুরোধ পায় নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ।
এর প্রথম চারটি অনুরোধে তারা ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের কয়েকটি অ্যাকাউন্টে ৮১ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করে। এরপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে ওই টাকার প্রায় অর্ধেক চলে যায় ক্যাসিনোর জুয়ার টেবিলে। বাকি টাকার কোনো হদিস ফিলিপিন্সের তদন্তকারীরা পাননি। বাংলাদেশের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশাও তারা দেখাতে পারেননি।
আর পঞ্চম আদেশে শ্রীলঙ্কায় প্যান এশিয়া ব্যাংকিং কর্পোরেশনে একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলে সন্দেহ জাগায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
অর্থ চুরি যাওয়ার বিষয়টি প্রায় এক মাস চেপে রাখায় সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন আতিউর রহমান। সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ চুরির ঘটনায় ১৫ মার্চ ঢাকার মতিঝিলে একটি মামলা করে।
এজাহারে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নামে যাওয়া অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে চেয়ে ফেডারেল রিজার্ভ সুইফট সিস্টেমে বার্তা দিলেও প্রিন্টার নষ্ট থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা তা জানতে পারেন একদিন পর। কোথাও ঘাপলা আছে টের পেয়ে ৬ ফেব্র“য়ারি ঢাকা থেকে নিয় ইয়র্কে ই-মেইল পাঠিয়ে অর্থ স্থানান্তর বন্ধ করতে বলা হলেও ততোক্ষণে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার দুটি ব্যাংকে চলে যায় ১০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় অর্থ স্থানান্তরের কাজটি হয় ওয়েলস ফারগো, ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মেলন ও সিটি ব্যাংক নিউ ইয়র্কের মাধ্যমে। অর্থ পরিশোধের অনুরোধ কার্যকরের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর ‘যথাযথ নিয়ম না মানার বিষয়টি’ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের কাজে থাকা এগমন্ট গ্রুপ, এপিজিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আই, দেশটির অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাকেও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।
৮ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ফিলিপিন্সে জমা করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি প্রকল্পের ঋণ ও পরামর্শক ফির নামে। ফিলিপিন্সের চার ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে এতো বড় অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং আইনের নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে কি-না সে খোঁজও নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ৩০টি পরিশোধ আদেশের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃসম্মতি এবং চারটি পরিশোধের বিষয়ে অধিকতর ব্যাখ্যা চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বার্তা পাঠিয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভ। ব্যাখ্যা পাওয়ার আগেই তারা তাদের করেসপন্ডেন্ট তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় অর্থ স্থানান্তর করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও উত্তর পায়নি বাংলাদেশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর আইনি দায় সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। সেই পরামর্শের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দাবির মামলাও হতে পারে।
এস কে সুর চৌধুরী বলেন, “সেখানে কোনো ঘাটতি থাকলে প্রয়োজনে মামলা করা হবে।