Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

43খোলা বাজার২৪, বুধবার, ১৫ জুন ২০১৬: কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ: ঠাঁঁঠাঁ বরেন্দ্রভূমি নওগাঁর বেশ কিছু এলাকা খরা প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। জেলার পত্মীতলা, সাপাহার ও পোরশার অনেক এলাকায় প্রকৃতিগত কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে। শত শত বিঘা জমি অনাবাদি ফেলে রাখতে বাধ্য হন এসব এলাকার কৃষকরা। এমনকি খাবার পানির জন্যও হাহাকার করতে হতো এসব এলাকার মানুষকে। বৃষ্টি নির্ভর ফসল এবং খাবারের জন্য পুকুরের পানিই ছিল এদের একমাত্র ভরসা। কিন্তু বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) স্থাপতি সোলার পাতকুয়া পাল্টে দিয়েছে সেই দৃশ্য। বরেন্দ্র এলাকার পতিত জমিতে এখন সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বিএনমডিএ’র নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নলকূপের সাহায্যে পানি উঠে না এমন এলাকায় পানির সংকট দূর করতে দীর্ঘ জরিপ ও অনুসন্ধানে নামে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। কয়েক বছর ধরে জরিপ ও অনুসন্ধান চালিয়ে এসব এলাকায় পাতকুয়া বসানোর সিন্ধান্ত নেয় বিএমডিএ। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৩ সালে বরেন্দ্র এলাকা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর যেসব এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে, সেসব এলাকায় ১০০টি পাতকুয়া বসানোর কাজ শুরু করে। ওই প্রকল্পের অধীনে নওগাঁর পত্মীতলা, সাপাহার ও পোরশায় ৭০টি পাতকুয়া বসানো হয়। যার ৪২টি পাতকুয়া পত্মীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়ন, নির্মইল, শিহাড়া ও মাটিন্দর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বসানো হয়েছে। আরসিসি ডিজাইনে নির্মিত এসব কুয়া হতে কপিকল সিস্টেমে ২০০ থেকে ৩০০ ফিট নিচু ভূগর্ভ হতে পানি তোলার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ কুয়ার উপর নির্মিত আরসিসি পিলারে একটি বিয়ারিং বসিয়ে তাতে রশি বা চেইন লাগিয়ে বালতির সাহায্যে পানি তেলা হয়। বিএমডিএ’র বসানো এসব পাতকুয়ার ফলে খরাপ্রবণ এসব এলাকার কয়েক হাজার বাসিন্দার সুপেয় পানির সংকট দূর হয়েছে।
২০১৫ সালে বিএমডিএ পাতকুয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প হাতে নেয়। এর অংশ হিসেবে পত্মীতলা উপজেলার শিহাড়া, দিবর, পোরশার বাদ কহেন্দা ও লেলেংগাহার এলাকার গ্রামে পাতকুয়ায় সোলার প্যানেল বসিয়ে এর আশপাশের এলাকার পতিত জমিতে কৃষি আবাদ শুরু করেছে। সোলার প্যানেলের ক্ষমতা ৯০০ ওয়াট এবং পাম্পের ক্ষমতা ৫০০ ওয়াট। সোলার প্যানেল পাতকুয়ার উপর ফানেল আকৃতিতে স্থাপন করে বৃষ্টির পানি কুয়াতে সংগ্রহ করা হয়। কুয়া থেকে সোলার পাম্পের সাহায্যে ইউপিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি তুলে প্রথমে হেডার ট্যাংকে ধারণ করা হয়। এরপর সেখান থেকে আবার ১৮০০ ফুট ভূ-গর্ভস্থ পাইপ নালা এবং সেচের জন্য ২১টি করে ট্যাপের আশপাশের জমিতে দেওয়া হয়। প্রতিটি পাতকুয়ার অধীনে ৮ একর পর্যন্ত জমিতে গম, আলুসহ বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি আবাদ করা যায়। এর ফলে এলকায় বৃষ্টিনির্ভর ফসলের এলাকায় এখন সারাবছর ফসল আবাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বিএমডিএ’র বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের পরিচালক শিব্বির আহম্মেদ জানান, এই পাতকুয়ার মাধ্যমে জমিতে সেচের পানি কম লাগে এমন শাক-সবজি চাষ করা হচ্ছে। প্রথম দফায় নির্মিত ১০০টি পাতকুয়ার মধ্যে চারটিতে পরীক্ষামূলকভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে পাতকুয়ায় সোলার পদ্ধতিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিনা খরচে স্থানীয় লোকজন পাতকুয়ার পানি ব্যবহার করতে পারছেন। এই প্রযুক্তি লোকজনের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলায় বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের আরও দীর্ঘ মেয়াদী করা এবং সব এলাকায় এটা ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরেজমিনে এসব সোলার পাতকুয়া দেখে ও উপকারভোগী মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোলার প্যানেল বসানো পাতকুয়া থেকে সেচ পানি নিয়ে স্থানীয় লোকজন বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি চাষাবাদ করছেন। এর ফলে তাঁদের আর্থ-সামাজিক জীবনমান বদলে যেতে শুরু করেছে।
পত্মীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের চকশহবত গ্রামে পাতকুয়ায় সোলার পাম্প বসানো হয়েছে। সেই পাতকুয়ার উপকারভোগী ফণী বর্মণ, মাসুম রানা ও সুকুমার জানান, অনেক আগে তাঁদেরকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দিবর দিঘী থেকে পানি আনতে হতো। সেই পানি খেয়ে লোকজনের বিভিন্ন ধরণের অসুখ-বিসুখ হতো। ১৫-১৬ বছর আগে পাশের গ্রামে একটি তারা পাম্প (নলকূপ) বসানো হয়। এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে বাড়ির মেয়েরা সেই পানি নিয়ে আসত। সেই পাম্পটিও মাঝে মাঝ নষ্ট হয়ে যেত।
ফণী বর্মণ বলেন, ‘বরেন্দ্র যখন হামাগেরে এতি কুয়া বসাল তখন হামাগের খুশির শ্যাষ আছিল না। এখন সোলার পাম্প লাগাইছে। পাতকুয়ার জল দিয়ে আবাদও করা যাচ্ছে। বরেন্দ্রের পাতকুয়া হামাগেরে কাছত আশির্বাদ হয়ে আসিছে।’
উপজেলার শিহাড়া গ্রামে সোলার পাম্প দিয়ে চালিত পাতকুয়ার পানি ব্যবহার করে ১০ কাঠা জমিতে পিয়াজ ও বেগুন লাগিয়েছেন রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘পাতকুয়া ও সোলার পাম্প হওয়ার আগে এই জমিতে বর্ষার সময় ছাড়া আবাদ হতো না। এখন এখানে খরা মৌসুমেও বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ করছি।’
দিবর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বলেন, খরা প্রবন ও রুক্ষ এই এলাকায় পাতকুয়া বসানোর বলে লোকজন সুপেয় পানি পান করতে পারছেন। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সব জায়গায় পাতকুয়া বসানো হয়নি। আরও অনেক গ্রামে পাতকুয়া দরকার। এই ইউনিয়নে আরও ৫০-৬০টি পাতকুয়া খনন কওে সোলার পাম্পের মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহ করার সুযোগ রয়েছে।
বিএমডিএর পত্মীতলা অঞ্চলের সহকারী প্রকৌশলী আল মামুনুর রশীদ বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় নুতুন করে গভীর নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএমডিএ। কেনন্া এই এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ অনেক গভীর পানির তোলার ফলে ভারী পানি (আর্সেনিক সমৃদ্ধ) উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু মানুষের খাবার পানি ও কৃষিতে সেচ চাহিদা পূরণের জন্য বিকল্প পদ্ধতি খোঁজা হচ্ছিল। বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে খাবার পানির চাহিদা পূরণের জন্য ২০১৩ সালে পাতকুয়া বসানোর এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরে পাতকুয়ায় সোলার পাম্প বসিয়ে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প গ্রহণ করে বিএমডিএ। এই কার্যক্রম আরও বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিএমডিএ নওগাঁ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক সংবাদকে বলেন, পাতকুয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প পরিচালনার বিষয়টি সর্ব প্রথম কৃষি মন্ত্রী বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে জানান। তাঁর কথা মতো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পাতকুয়ার সোলার প্যানেল বসিয়ে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প চালু করা হয়। প্রথমে চারটি পাতকুয়ায় সোলার পাম্প বসিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও ৫০০টি সোলার পাম্প পরিচালিত পাতকুয়া বসানোর জন্য কৃষি মন্ত্রাণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্পটি কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাশ হয়েছে। এখন এটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার অনাবাদি জমি কৃষি আবাদের আওয়াতায় আসবে।