Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

24kএ এম এম শওকত আলী । খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট ২০১৬: আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কৃষি মন্ত্রণালয়ে তিস্তা বাঁধ প্রকল্পভুক্ত এলাকায় সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন-সংক্রান্ত এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকজন কৃষি ও পানি বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রণীত এক সমীক্ষার ফলাফল পেশ করা হয়। এ সমীক্ষার আয়োজক ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিনীতি বিষয়ক ইউনিট, যার ইংরেজি নাম অ্যাগ্রিকালচার পলিসি সাপোর্ট ইউনিট—সংক্ষেপে আপসু (অচঝট)। উল্লেখ্য, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বহু বছর আগেই এ ধরনের একটি ইউনিট গঠন করা হয়, যার নাম ফুড পলিসি মনিটরিং ইউনিট—সংক্ষেপে এফপিএমইউ। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এই ইউনিট গঠনে ওই সময় কারিগরি সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রদান করে। বর্তমানেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতিবিষয়ক ইউনিট গঠনে একই সংস্থা কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। আপসু এখনো পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করেনি। কারণ এ ইউনিটের স্থায়ী জনবল চূড়ান্ত হয়নি। তবে আশা করা যায়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। যে সমীক্ষা সভায় আলোচনা করা হয়, তার শিরোনাম হলো—তিস্তা ব্যাসিন অঞ্চলে সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন-সংক্রান্ত কৌশল পরিকল্পনা। সমীক্ষায় তিস্তা ব্যাসিনের আওতায় রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলা উল্লেখ করা হয়। এতে মোট ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ হেক্টর চাষযোগ্য জমি দেখানো হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে পানির প্রবাহ ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে গ্রামীণ ও শহরে বসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিসম্পন্ন এলাকা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বে এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মোট পানিসম্পন্ন এলাকা ৮৯ হাজার হেক্টর সমৃদ্ধ বিভিন্ন ধরনের জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে নদীর আয়তনই সর্বাধিক।

স্মরণ করা যেতে পারে, সত্তরের দশকের শেষভাগে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের চিন্তাভাবনা সরকার শুরু করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আমন চাষের জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করা। আমন ধান বৃষ্টিনির্ভর। বৃষ্টি কম হলেই সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। সম্পূরক সেচ বাঁধ নির্মাণের ফলে সেচকাজ সম্ভব হবে। জানামতে, ওই সময় বিদেশি সাহায্যের জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে অনুরোধ করা হলেও তারা কেউ সাড়া দেয়নি। কারণ নদীর উপরিভাগে—অর্থাৎ ভারতে বাঁধ নির্মাণ করলে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প পানিশূন্যতা অথবা স্বল্পতার শিকার হবে—অর্থাৎ সেচের জন্য পানি পাওয়া যাবে না। যে আশঙ্কা বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো প্রকাশ করেছিল, তা এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরে এ বাস্তবতা নিয়েই তিস্তা বাঁধ প্রকল্প এলাকার চাষিদের বসবাস। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৪-১৫ সালে সম্পূরক সেচের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় ৭০ হাজার হেক্টর। বাস্তবে করা হয় ১৬ হাজার ৬৬৮ হেক্টর। রবি মৌসুমে মাত্র আট হাজার ৫৭২ হেক্টর। এ সংখ্যা মোট সেচযোগ্য এলাকার মাত্র ১ শতাংশ। বাকি এলাকা ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে করা হয়। এতে অগভীর নলকূপের এলাকাধীন পরিসংখ্যান ৯০ শতাংশ। ৮ শতাংশ গভীর নলকূপ। সভার আলোচনায় ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে সমঝোতা অর্জনের সুপারিশ করা হলেও ভিন্নমত ছিল। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ও অনিশ্চিত। এ জন্য পরিকল্পনা কৌশল প্রণয়নের জন্য ভারতের পানি পাওয়া যাবে না—এটা ধরে নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিনির্ভর আমন ও আউশের এলাকা বৃদ্ধির কৌশল বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্ব প্রদান করা হয়। কারণ অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হলে পরিবেশ বিপন্ন হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় আমন ও আউশচাষিদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থাও করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভূগর্ভস্থ সেচ এলাকা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৬ সালে ভারতের পশ্চিম বাংলায় বহুমুখী বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প এলাকায় চাষিদের দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে পানির প্রাপ্যতা ছিল মাত্র ২৫০ কিউসেক। এ ছাড়া ওপর থেকে হঠাৎ পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে তিস্তাসংলগ্ন এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙনও শুরু হয়। ওই এলাকার বাসিন্দারা তখন অন্যত্র চলে যায়। ১৯৭৯ সালে তিস্তা বাঁধ নির্মাণ শুরু হলেও এটা কার্যকর হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে। কিন্তু এখন ৯৭ কিলোমিটার এলাকা বস্তুত পানিশূন্য। এর প্রভাব পার্শ্ববর্তী কিছু ছোট নদীতেও দৃশ্যমান। কয়েক বছর ধরেই কৃষি পরিকল্পনাবিদরা কৃষির ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এখন দ্বিমুখী সমস্যার সম্মুখীন। ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পাওয়ার ফলে এ উেসর পানি সেচকাজে ব্যবহার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিনির্ভরতাও পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক নয়, বরং ক্ষতিকারক। সমীক্ষার প্রণেতারা এ কারণেই হয়তো সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের সুপারিশ করেছেন। অর্থাৎ একমাত্র ফসল উৎপাদনের ওপরই কৃষকের আয় নির্ভরশীল নয়। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে মৎস্য চাষসহ পশু পালন ও অন্যান্য উৎস। ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষ ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের ওপর এ কারণে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে সমন্বিত উৎপাদন লব্ধ কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও করতে হবে। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে বিবেচনা করলে প্রদত্ত সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা যায় না। কিন্তু মৎস্য চাষের সম্ভাবনা কতটুকু। আলোচ্য সমীক্ষায় প্রদত্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪২৩ হেক্টর মৎস্য বসতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। আরো বলা হয়েছে যে পাঁচটি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্ত হয়েছে আর ঝুঁকির মুখে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মৎস্য। এর মূল কারণ, শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতা। এ চিত্র শুধু তিস্তা এলাকায় নয়, বরং অন্যান্য এলাকায়ও দৃশ্যমান। অন্যান্য এলাকায় বিকল্প মৎস্য চাষের—অর্থাৎ অ্যাকোয়াকালচার করা হচ্ছে। ভিন্ন প্রজাতিসহ দেশজ প্রজাতির মাছও অধিক হারে উৎপাদন করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এর বেশির ভাগই বদ্ধ জলাশয়ে করা হয়।
তৃতীয় যে ক্ষেত্রটি সমীক্ষায় চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো, প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকদের বিকল্প আয়ের উৎস। এ লক্ষ্যে বলা হয়েছে, গবাদি পশুর সংখ্যা ৩৯ লাখ ১০ হাজার। মহিষ ৪২ হাজার, ছাগল ২০ লাখ ৭৪ হাজার, ভেড়া ১৪ লাখ ৪০ হাজার ও হাঁস ১০ লাখ ৪১ হাজার। এ পরিসংখ্যানের উৎস কী তা সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়নি। সরকারি পর্যায়ে যখন কোনো সমীক্ষা আলোচিত হয় তখন একমাত্র সরকারি প্রকল্পের কথা চিন্তা করা হয়। তবে এ সমীক্ষা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ও উল্লেখ করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে সরকারের একটি সরকারি-বেসরকারি নীতি কয়েক বছর আগেই প্রণয়ন করা হয়েছে। জানা মতে, এর জন্য একটি আইনও রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে সরকার কত অর্থের জোগান দেবে সে কথাও বলা আছে। এ সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্পের সংখ্যা বিরল। এ ধরনের সুপারিশ করার আগে কেন সরকারি নীতি এ ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে না তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। সবশেষে বাজার উন্নয়নসহ ভ্যালু চেইনের সুপারিশ সমীক্ষায় করা হয়। এ লক্ষ্যে কিছু পরিসংখ্যানও উল্লেখ করা হয়েছে, যার উৎস ২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এর মধ্যে গ্রোথ সেন্টারের সংখ্যা ২২২ ও বাজারের সংখ্যা ৯৬৯। শেষোক্ত ক্ষেত্রে সরকারের কৃষি বিপণন দপ্তর মাত্র ১৮টির উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে।
এ বছর পানিশূন্যতার জন্য কৃষকরা কষ্ট পেয়েছেন। এ সত্ত্বেও তাঁরা আমন চাষ করেছিলেন। কারণ ওই এলাকায় ৪৪ শতাংশ জমিতে আমন চাষ অতীতে তাঁরা করেছেন। কিন্তু এ বছর বন্যার পানিতে ডিমলা এলাকায় আমনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। এ-সংক্রান্ত চিত্র প্রকাশ করা হয় একটি দৈনিকে। চিত্রে দেখা যায়, আমন ধানের কোনো চিহ্ন নেই। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এক স্থানীয় কর্মকর্তার হিসাবে সর্বমোট ক্ষতির পরিমাণ ১০৫ কোটি টাকা। সর্বমোট ফসলি জমির ক্ষতির পরিমাণ ১৩.৫ হাজার হেক্টর। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নীলফামারী ও রংপুর এলাকার চাষিরা দেরিতে চাষ করা যায় এমন ধানের বীজের জন্য চেষ্টা করছেন। এ ধরনের বীজের মধ্যে রয়েছে ব্রি-৫১ ও ব্রি-৫২। কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের কর্মকর্তারা ৫.২২ লাখ হেক্টরে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা পূর্বে নির্ধারণ করেছিলেন। এ লক্ষ্য এখন আর অর্জন করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা গেছে। বন্যা হলেই প্রতিবছর কৃষি পুনর্বাসনসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। এ বছর এখন পর্যন্ত এ ধরনের উদ্যোগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অনুমান করা যায় যে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়ার পরই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এর জন্য কালক্ষেপণ হলে দেরিতে আমন চাষ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে তিস্তা বাঁধ প্রকল্পভুক্ত চাষিদের দুঃখ আরো বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
[সংকলিত]