খোলা বাজার২৪,রবিবার,০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬: ভারতীয় পানি ও বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন জেলা। পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। পানির প্রবল স্রোতে নড়াইলের লোহাগড়া, রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। হুমকিতে এসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। এদিকে বন্যার কারণে দেশের বড় বড় নদীগুলোতে পানি বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। প্রবল স্রোতে আবার ভাঙন ধরেছে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে। ফলে বিপর্যয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ভাঙনের হুমকিতে আরও অনেক ছোট, বড় নদী। এসব নদী তীরবর্তী জেলার মানুষও রয়েছেন ঝুঁকিতে। দেশের বন্যা পরিস্থিতির এ অবস্থায় সরকারি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী ভাঙন রোধ ও বন্যাদুর্গত এলকার মানুষের সীমাহীন দুর্দশায় সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না থাকায় ক্ষুব্ধ ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকিতে থাকা লাখ লাখ মানুষ। : লোহাগড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধে ভাঙ্গন : আমাদের লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি জানান, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়নেন ঘাঘা এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে উপজেলার চার ইউনিয়নের ১৭টি গ্রাম এবং ১৩টি মাঠের ফসল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নড়াইল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওই এলাকা নদীতে বিলীন হলে ওই বছরই পুনরায় নতুন করে তার পাশে মাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হয়। ওই বাঁধে এখন ভাঙন দেখা দিয়েছে। গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘাঘা গ্রাম এলাকায় প্রায় আধা কিলোমিটার অংশে বাঁধের অধিকাংশ মধুমতী নদীতে বিলীন হতে চলেছে। বাঁধের পাঁচ জায়গায় অর্ধেকের বেশি অংশ নদীতে চলে গেছে। বাকিটুকুতে ফাটল ধরেছে। ফাটলগুলো আস্তে আস্তে নদীতে চলে যাচ্ছে। এর দুটি জায়গায় বাঁধের পাউবো বালুর বস্তা সাজিয়ে পানি ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এ জায়গায় তীব্র স্রোত থাকায় পানিতে পাক খাচ্ছে। এলাকার মানুষ নদীর পাড়ে ভিড় করছেন। তারা দ্রুত নদীর ভাঙনরোধ এবং নতুন বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। : স্থানীয় লোকজন জানান, প্রতি বছরই এখানে ভাঙন দেখা দেয়। যেকোনো মুহূর্তে বাঁধের ওই অংশ নদীতে বিলীন হবে। আর তখন কোটাকোল, ইতনা, মল্লিকপুর ও দিঘলিয়া ইউনিয়নের ১৭টি গ্রাম এলাকা বন্যায় প্লাবিত হবে। এতে ফসল ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক পবিরার আশ্রয়হীন হবে। এছাড়া এ এলাকার ফটকের বিল, ঘাঘা, রাধানগর, ইতনা, পাংখারচর, পাচুড়িয়া, মঙ্গলহাটা, মল্লিকপুর, দিঘলিয়া, সোনাদাহ, কোটাকোল, যোগিয়া ও ধলইতলার মাঠের ফসল পানিতে তলিয়ে যাবে। এছাড়া এ বাঁধটি এলাকার তিনটি ইউনিয়নের লোকজনের চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। : ঘাঘা গ্রামের সোহাগ শেখ (৩২) জানান, তাদের ঘাঘার মাঠে চার একর জমিতে আমন ধান এবং তিন একরে পাট আছে। বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকলে এসব ফসল মুহূর্তে পানির নিচে চলে যাবে। তিনি বলেন, এক একর ফসলি জমি নদীতে চলে গেছে। দুইবার বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে না খেয়ে মরতে হবে। ওই গ্রামের রাসেল শেখ (৩৫) বলেন, ঘাঘার মাঠে সাড়ে পাঁচ একর জমিতে আমন ধান এবং প্রায় তিন একরে পাট আছে। এর ওপরই চলে সারা বছরের সংসার। এটি প্লাবিত হলে পথে বসতে হবে। : ইউপি চেয়ারম্যান মো. হিমায়েত হোসেন বলেন, এ এলাকার ১৭টি গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে হলে নতুন বাঁধ নির্মাণ করে পানি ঠেকানোর পাশাপাশি নদী ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাউবোর লোহাগড়া উপজেলা দায়িত্বপ্রাপ্ত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ এইচ এম আল জহির বলেন, যেকোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে এলকায় পানি ঢুকতে পারে। তাই পানি ঠেকানোর চেষ্টা হচ্ছে। এছাড়া ওই এলাকার ভাঙনরোধে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো আছে। কিন্তু এখানো বরাদ্দ হয়নি। : আবারও ভাঙনে বিপর্যস্ত দৌলতদিয়া ফেরিঘাট : তীব্র স্রোতে পদ্মার ভাঙনে আবারও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। সবগুলো ঘাটে ফেরি ভিড়তে না পারায় দুই পাড়েই সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এই রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা। এ অবস্থার উন্নতি না হলে আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রা কতটা নির্বিঘœ হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। : প্রায় দুই মাস ধরে পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে ঘাট এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়ায় যানবাহন পারাপার ব্যাহত হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে দৌলতদিয়ার ৩ নম্বর ঘাটের র্যামের নিচ থেকে সংযোগ সড়কের প্রায় ৩৫ ফুট অংশ পদ্মায় বিলীন হলে ঘাট বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া ১ নম্ব^র ঘাটটি ভাঙনের কারণে গত ৬ আগস্ট থেকে বন্ধ রয়েছে। এতে করে চারটির মধ্যে দুটি ঘাটই বন্ধ থাকায় বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, ৩ নম্বর ঘাটের বাম পাশের র্যামের সংযোগ সড়কের মাটি ধসে যাওয়ায় ঘাটটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২ ও ৪ নম্ব^র ঘাট চালু থাকলেও ২ নম্বর ঘাটে তীব্র স্রোত থাকায় শক্তিশালী ইঞ্জিনবিশিষ্ট রো রো ফেরি ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মওলা ও ভাষা শহীদ বরকত ছাড়া অন্য কোনো ফেরি ভিড়তে পারছে না। ফলে কার্যত এই ঘাটটিও অচল। ৪ নম্বর ঘাটে ভিড়তে না পেরে ফেরি জট লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করলে ঈদুল আজহার সময় পরিস্থিতি কি হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। : গতকাল শনিবার দেখা যায়, নদী পাড়ি দিতে না পেরে ঘাট থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার সড়ক জুড়ে দুই লাইনে পশুবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাসসহ কয়েক শ যানবাহন আটকে আছে। যশোর থেকে আসা ঈগল পরিবহনের যাত্রী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে আটকে আছি। কিন্তু এখনো ফেরিতে উঠতে পারিনি।’ ট্রাক চালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঝিকরগাছা থেকে এসে এখনো আটকে আছি। আমার মতো অন্তত শতাধিক ট্রাক দুই দিন ধরে ঘাটে আটকে আছে।’ : বিআইডব্লিউটিএ আরিচা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী শাহ আলম বলেন, ‘৩ নম্বর ঘাটের ওপর অনেকটা আশাবাদী ছিলাম কিন্তু শুক্রবার মধ্যরাতে সেটি ভাঙনের কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। এটি ঠিক করতে গিয়ে প্রায় এক মাস বন্ধ থাকা ১ নম্বর ঘাট চালু করতেও দেরি হচ্ছে। আগামী সোম বা মঙ্গলবারের আগে চালু করা সম্ভব না।’ : ঈদের আগে ঘাটের পরিস্থিতি দেখতে গতকাল শনিবার বেলা একটার দিকে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান দৌলতদিয়ায় আসেন। ৩ ও ৪ নম্ব^র ঘাট ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রা নির্বিঘœ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং নৌপরিবহন মন্ত্রী সার্বক্ষণিক ঘাট পরিস্থিতির খোঁজ নিচ্ছেন। যাত্রী পারাপার বা নৌযান চলাচলে যাতে বিঘœ না ঘটে এ জন্য সার্বক্ষণিক কাজ চলছে। : পদ্মার ভাঙনে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যানবাহন পারাপার ব্যাহত হচ্ছে। ফলে আটকা পড়েছে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাসসহ শত শত যানবাহন। : পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বলেন, ‘নদী ভাঙনে বারবার ঘাটের র্যাম ভেঙে যাচ্ছে। ফেরির সংখ্যা স্বাভাবিক থাকলেও ঘাট সংকটে গাড়ি পারাপার ব্যাহত হচ্ছে। ঘাটে প্রায় পাঁচ শ গাড়ি আটকে আছে। শুধু ৪ নম্বর ঘাট দিয়ে গাড়ি পারাপার হচ্ছে। দ্রুত চালু না হলে ঈদে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। যানবাহন ও মানুষের পারাপার যাতে বিঘœ না হয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে, এ জন্য পুরো ঘাট এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে।’ : রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না : সপ্তাহজুড়ে কাজ করেও রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের টি-গ্রোয়েনের ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করছে, আপাতত ভয়ের কোনো কারণ নেই। এই টি-গ্রোয়েন শহর রক্ষা বাঁধকে পদ্মার তীব্র স্রোত থেকে আগলে রেখেছে। : গত কয়েকদিন ধরেই পানি কমছে পদ্মায়। কিন্তু স্রোতের তীব্রতা এখনো কমেনি। গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে স্রোতের তীব্রতা আরো বেড়েছে। ফলে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে রাজশাহী ‘টি’ বাঁধ রক্ষা নিয়ে। তাই বাঁধ রক্ষায় কৌশল পাল্টেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এদিন সকাল থেকে সারাদিনই ফেলা হয়েছে কংক্রিটের ব্লক। এর আগে জিও ব্যাগ (বালুর বস্তা) এবং তারও আগে পাথর ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এগুলোতে ভাঙন খানিকটা ঠেকানো গেলেও প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙন থামানো যায়নি। ফলে খুব একটা লাভ হয়নি। এ কারণে নতুন করে বড় বড় ব্লক ফেলা হচ্ছে। এর একেকটির ওজন ছয় মণেরও বেশি। তবে ব্লক দিয়ে শেষরক্ষা হবে কি না তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছেন না। : এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভাঙন পরিদর্শনে রাজশাহী ‘টি’ বাঁধে যান পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী। তিনি ভাঙনের প্রতিরক্ষামূলক কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। তবে এ সময় কাজ বন্ধ ছিলো। তিনি জানান, এখন পদ্মায় পানিপ্রবাহ রয়েছে ১৮ দশমিক ২৭ মিটার। প্রতিদিনই ধীরে ধীরে কমছে পানি। এ কারণে স্রোতের প্রবল হচ্ছে। আর তীব্র স্রোতের কারণে টি-বাঁধের কাছে নৌকা ভেড়ানো যাচ্ছে না। ফলে মেরামত কাজ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আশা করা যাচ্ছে, টি-বাঁধে আর নতুন করে ভাঙন দেখা দেবে না। পুরো পদ্মার গতি ও প্রকৃতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। : রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল হান্নান বলেন, এই বাঁধ নিয়ে তারা চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। আতঙ্কে দিন কাটছে সবারই। হঠাৎ করে ভারত ফারাক্কার সব গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফারাক্কার অভিশাপ এখন শুধু আমরা নয়, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গও বুঝতে পেরেছে। তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে না ফেলার কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। উল্লেখ্য, গত ২৮ আগস্ট থেকে রাজশাহী ‘টি’ বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। এরপর থেকে টানা প্রতিরক্ষার কাজ চলছে রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধে। – See more at: http://www.dailydinkal.net/2016/09/04/28261.php#sthash.qfsWCu9R.dpuf