Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

45খোলা বাজার২৪,শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬: মতিহারের সবুজ চত্বর হয়ে উঠেছে বিষাদময়। সবুজের উচ্ছ্বাস হারিয়ে হয়ে পড়েছে মলিন। শোক আর বিষাদে ছেয়ে আছে মতিহারের সবুজ চত্বর। নিকশ আঁধার পেয়ে বসেছে মতিহারকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে প্রিয় শিক্ষাঙ্গণে। প্রিয় শিক্ষককে হারিয়ে শিক্ষার্থীরা বেদনায় নীল হয়ে আছে। তাদের সবারই প্রশ্ন আকতার জাহান জলির মতো বিশাল মানসিকতার এ ব্যক্তিত্বের কীভাবে নিজেকে শেষ করতে পারেন। মায়াময় এ পৃথিবীর সব কিছু ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

মতিহারের এই গভীর শোক ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের কান্না ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সামাজিক এই মাধ্যমে তাদের প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। আর বর্তমান শিক্ষার্থীরাও সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে ফেসবুকে লিখছেন প্রিয় শিক্ষক আকতার জাহান জলিকে নিয়ে। তাদের লেখা বলছে, তারা শোকাহত, তারা মর্মাহত, তারা নির্বাক, তাদের হৃদয় যেন বেদনায় লীন।
প্রিয় শিক্ষককে হারানোর শোকে ফেসবুকে কালো একটি ছবিকে প্রোফাইল পিকচার বানিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। তার ছবিতে শুধু কালো আর কালো, আর কিছু নেই। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আর পারছি না। ম্যাম আমাদের রিপোর্টিং পড়াতেন। শিখিয়েছেন কীভাবে কারো মৃত্যু সংবাদ লিখতে হয়। আজ তারই মৃত্যু নিয়ে লিখতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে তার কক্ষে পাওয়া সুইসাইড নোট নিয়ে। না না। এ সত্য নয়। দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্লিজ কেউ বলেন সত্য নয়, স্বপ্ন দেখছি।’
আরেক ছাত্র তার স্টাটাসে লিখেছেন, ‘লাশকাটা ঘরে ফেলে এসেছি আপনার দেহ। কিন্তু ফেলতে পারি নি আপনার গভীর স্মৃতি। ম্যাম, আপনি প্রচণ্ড স্বার্থপর। হিম ঠাণ্ডায় কেমন করে ঘুমাচ্ছেন। আমরা ঘুমাতে পারছি না। আপনার স্মৃতিগুলো যন্ত্রণায় বিদ্ধ করছে। ম্যাম সবাইতো আপনাকে জানে না। ওরা কত কটুকথা বলবে। আপনার তো এটা প্রাপ্য ছিল না। আপনার মতো মানুষদের এভাবে যেতে হয় না। আপনি বোঝেন না? মায়ের অকাল মৃত্যুতে সন্তানদের অবস্থা কেমন হয়। তখন আমাদের কথা মনে হয়নি? একটুও মিস করেন নি? না জানি কত কষ্ট পেয়ে আমাদের কথা ভুলে চলে যেতে বাধ্য হলেন। ভাবতে পারছি না।’
ঈদের ছুটিতে বাড়িয়ে গিয়েছেন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরাফাত সিদ্দিকী। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে ছুটে গেছেন জুবেরি ভবনে। পরে রাতে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যার লেখা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্ল্যাকবোর্ডে দেখেছি, ইনকোর্স পরীক্ষার খাতাতে আমার ভুলগুলোর পাশে যিনি সুন্দর করে মন্তব্য লিখতেন, যা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম, সেই হাতের লেখা দেখলাম আজ অনেকদিন পর, একটি ‘সুইসাইড নোটে’।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মেহেরুল হাসান সুজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পরীক্ষার হলে যতোবারই ম্যাডাম পরিদর্শক হিসেবে থাকতেন, অতিরিক্ত খাতা আনতে গেলেই বলতেন, ‘মেহেরুল, তুমি যেন এখন কোন কাগজে কাজ করছো?’ ম্যাডাম হেসে বলতেন, ‘ও, ভুলে যাই শুধু।’ এমন অসংখ্য স্মৃতি আকতার জাহান ম্যাডামের সঙ্গে।
বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব আলম লিখেছেন, ‘আপনি তো অনেক যতœ করেই রিপোর্টিং শেখাতেন ম্যাম; তারপরও কেন আজ আপনার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে হাতটা কাঁপছিল, কেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল? রিপোর্টিং শিখিয়ে কী আজ সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা নিলেন আপনি? পরীক্ষার হলে তো এসে বলতেন, ‘মাহবুব, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে।’
প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে তার সাবেক-বর্তমানের অগণিত শিক্ষার্থী রাতভর ফেসবুকে এমনই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজশাহীতে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরাও অধ্যাপক আকতার জাহানকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তারা কেউই আকতার জাহানের এমন চলে যাওয়া মানতে পারছেন না। তারা বলছেন- এমন ঘটনা শুধু অনাকাঙ্খিত নয়; রীতিমতো বিস্ময়ের। যা বিশ্বস করা যায় না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলি। শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে কক্ষের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কক্ষটির দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল। ওই কক্ষে আকতার জাহানের হাতে লেখা ‘অস্বাক্ষরিত’ একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কয়েক বছর আগে একই বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে আকতার জাহানের। স্বামী পরে বিভাগেরই আরেক ছাত্রী ও বর্তমান শিক্ষক সোমা দেবকে বিয়ে করে ঘরসংসার করলেও আকতার জাহান আর সেদিকে যাননি । থাকতেন একা। একমাত্র ছেলে ঢাকায় থাকেন। অন্যদিকে জুবেরি ভবনের এই কক্ষে একাই থাকতেন আকতার জাহান।
সুইসাইড নোটে তিনি তার সাবেক স্বামীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম। সোয়াদকে (ছেলে) যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে- সে যে কোনো সময় সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।’
শিক্ষিকা আকতার জাহানকে মানসিক পীড়ন করতেন তার সাবেক স্বামী। এটাই এখন সবার সামনে এসেছে। এই নিয়ে আকতার জাহানের প্রতি সবার সহমর্মিতার পাশাপাশি তার স্বামীর প্রতি ঘৃণাও ছড়িয়েছে সর্বত্রই।
জানা গেছে, আকতার জাহানের লাশ এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। দেহটি তার রাজশাহী মেডিকেল কলেজকে উৎসর্গ করেছেন মৃত্যুর আগে। তবে আত্মহত্যা করলেও কীভাবে করেছেন তার কারণটা এখনো অজানা সকলের।