ড. আবদুল লতিফ মাসুম । । খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ : সামরিক সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। ‘যায় দিন যেন ভালো যায়’। সামনের দিন যে কতটা খারাপ হতে পারে বিগত সাত বছরে বাংলাদেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সামরিক সমর্থিত আমলে আইনের কঠোর প্রয়োগ ছিল। সব কিছু দৃশ্যমান ছিল। সামরিক বাহিনীর বৈশিষ্ট্যগত কারণে ওই কঠোরতা মানুষ বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিল। তাদের আশা ছিল একটি গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়ে এলে তাদের দুঃখকষ্টের অবসান ঘটবে। রাজনৈতিক নেতারা যুক্তি দেখাচ্ছিলেন, অনির্বাচিত স্বৈরাচারের চেয়ে নির্বাচিত সরকার অবশ্যই বেহ্তের হবে। নির্বাচন পরবর্তীকালে বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওই একই মত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কপাল খারাপ। প্রমাণিত হলো, একটি সামরিক সরকারের চেয়ে বেসামরিক সরকার মানবাধিকারের জন্য কতটা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি ধরন ছিল। একটি আইনের লেবাস ছিল। ২০১৪ সালের ‘বোগাস নির্বাচন’-এর পর শাসকদলের সব দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে। তাদের জন্য অজুহাতের মওকাও জুটে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে যা কখনো ঘটেনি, তাই ঘটতে থাকে। বিদেশীদের প্রতি আক্রমণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ব্লগার হত্যা এবং অবশেষে গুলশান ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা গোটা জাতিকে বিহ্বল করে তোলে। সরকার প্রথম থেকেই সব অনিষ্টের জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে আসছিল। সন্ত্রাসী আক্রমণের ব্যাপকতার পর সরকারের জন্য সন্ত্রাস দমনের মহা সুযোগে বিরোধী দল তথা ভিন্নমতাবলম্বীদের নিধনের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হয়। ইতঃপূর্বের নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা এবং অন্যায় অত্যাচার সীমা লঙ্ঘন করে। যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ মাসে একবার দেখা যেত, তা প্রতি সপ্তাহের এমনকি এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কোনো দিন নেই যে সংবাদপত্রের হত্যা-গুম এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর না আছে।
সম্প্রতি সরকারের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নতুন সংস্করণ লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হতো সদ্য গ্রেফতার করা অপরাধীদের সাথে। এখন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সাথে। অভিযোগ এ রকম, যে ব্যক্তি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলোÑ সে হয়তো গ্রেফতার হয়েছে দুই-তিন মাস আগে। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের সময় যে সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের নাম বলে, পরে তারা বেমালুম অস্বীকার করে। পরিবারের লোকজন বা আত্মীয়স্বজন এ-দুয়ার ও-দুয়ার ঘুরে কোনো হদিস করতে পারেনি। তখনই পরিচয় মেলে যখন সে পরিচয় প্রিয়জনকে কাঁদায়। এমনও হয়েছে যে, লাশের পরিচয় দেয়াটা বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, এখনো অনেক জঙ্গির লাশ হিমাগারে পড়ে আছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় রীতিমতো যুদ্ধ হয়েছে। সরকারবিরোধীরা বলছে, ‘সব ঝুট হ্যায়’। কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, মরছে মানুষ। জঙ্গি সন্ত্রাসীদের হামলায় যারা মৃত্যুবরণ করছে তারাও এ দেশের মানুষ। অপর পক্ষে সরকার যাদের হত্যা করছে তারাও এ দেশের মানুষ। ‘ হে মোর দুর্ভাগা দেশ’!
আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা সীমানা অতিক্রম করেছে। গুম, অপহরণ ও নিখোঁজের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, অবশেষে জাতিসঙ্ঘ এ রকম ক্রমেই অবনতিশীল পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিগত ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘গুম, অপহরণ ও নিখোঁজ’-বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের কার্যকরী গোষ্ঠী (The United Nations Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances) বিষয়টিকে অত্যন্ত আতঙ্কজনক বলে অভিহিত করে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদ এর বিশেষ বার্ষিক অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। প্রতিবেদনটির বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়Ñ ২০১৫ সালে তারা বাংলাদেশসহ ৩৭টি রাষ্ট্র থেকে ৭৬৬টি গুম হওয়ার তথ্য রেকর্ড করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ পরিষদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৩১টি গুমের ঘটনা উপস্থাপন করে এবং মাত্র একটি ক্ষেত্রে তার জবাব পায়। জবাবে বাংলাদেশ সরকার জানায়Ñ যে ব্যক্তি সম্পর্কে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সে এখন মুক্ত। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা এসব বিষয় তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশে আসার অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে কোনো ইতিবাচক জবাব পাওয়া যায়নি। গত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব দেশে গুমের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল তা থেকে এ পরিসংখ্যান তিন গুণেরও বেশি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, প্রতিদিন এসব দেশে একটি করে গুমের ঘটনা ঘটছে। তারা আরো আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, প্রকৃত গুমের সংখ্যা প্রকাশিত পরিসংখ্যানের চেয়ে আরো অনেক বেশি। প্রতিবেদনে ‘চিরতরে গুম’ এবং ‘সাময়িক গুম’ দুটোই উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে গুমের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি, আধা সামরিক বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এসব গুমের ঘটনা ঘটায়। এমন কী ব্যক্তিকে ‘বিচারবহির্ভূতভাবে’ হত্যার জন্য কৌশল গ্রহণ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, গুম করা ব্যক্তির পরিবারবর্গ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশের একটি সক্রিয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তরফ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে ৪০টি, ২০১১ সালে ৪৯টি, ২০১২ সালে ৫৬টি, ২০১৩ সালে ৬৮টি এবং ২০১৪ সালে ৭৪টি ‘গুম’-এর ঘটনা ঘটে। ‘গুম’-এর ঘটনা ক্রমেই বেড়ে ২০১৫ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৫। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুলাই পর্যন্ত ‘গুম’-এর ৬০টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের গণনা করা হয়নি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একবার গুম হলে আর হদিস মিলছে না। অর্থাৎ সেটি হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যু। আবার কখনো কখনো সাময়িক গুমের ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে ঘুম করা ব্যক্তিকে অনেক টাকার বিনিময়ে মুক্ত করে আনা সম্ভব হচ্ছে। অন্যবিধ স্বার্থ ও শত্রুতা সাধনের জন্য গুম করা হচ্ছে। গুমের ঘটনা নতুন নয়। বাংলাদেশে মামলাবাজ মানুষেরা শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য মানুষ ‘গুম’ করত। তাদের হত্যা করা হতো অথবা দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। দুর্ভাগ্য, আমাদের ‘ভিলেজ পলিটিক্সের সেই কৌশল এখন জাতীয় রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে অবশেষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি তা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের অজুহাতে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করছে এবং এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করছে। এ বক্তব্যটি বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান সময়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে গুমের ঘটনা অহরহ, যত্রতত্র ঘটছে। যারা গুম করছে তারা সাদা পোশাকে থাকার কারণে এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন হচ্ছে যে, তাদের কতটা সরকারি বাহিনী করছে আর অপরাধীরা করছে। বাংলাদেশের মতো দেশে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে অপরাধীরা। বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, এ রকম একটি নির্দেশনা উচ্চ আদালতের রয়েছে। কিন্তু সরিষায় যদি ভূত থাকে তাহলে ওটা তাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। অসংখ্যবার দেশের রাজনৈতিক নেতারা এবং সুশীলসমাজের সদস্যরা সাদা পোশাকে গ্রেফতারে নিন্দা করছে। দাবি জানিয়েছে যাতে আর কোনো ব্যক্তি এভাবে সরকারি বাহিনীর দিয়ে গুম না হয়। বিগত কয়েক বছরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা থেকে স্থানীয় কমিশনার পর্যন্ত অনেকেই গুম হয়েছে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন ব্যক্তির সন্তানেরা গুমের শিকার হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেহেতু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সেহেতু এসব ‘গুম’কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিদের উত্থানের প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে যে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে সেখানে বিরোধী দল দাবি করছে তাদের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। সুতরাং বিষয়টি যাতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবার হতে না পারে- সরকাকেরর সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য সরকারের উচিত প্রথমত, প্রেস নোটের মাধ্যমে বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, আইনানুগ বা নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করা- যাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত হয়। জঙ্গি দমনে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন অনেকেই বহুবার বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা এবং নাগরিক সাধারণের সমর্থন জঙ্গি দমনে একটি অপরিহার্য বিষয়। আশা করি, সরকার বিষয়টি সেভাবে অনুধাবন করবেন। নিউটনের তৃতীয় সূত্র সবাই আমরা জানি- ‘Every action has its equal and opposite reaction’। অন্যায়, অপমান এবং হত্যা কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। যা প্রয়োজন তা হচ্ছে ‘সমঝোতা’। আর তা না হলে বিষয়টি বুমেরাং হতে পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!/ মানুষের অধিকারে/ বঞ্চিত করেছ যারে/ সন্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’ (গীতাঞ্জলী : ১০৮)
[সংকলিত]