খােলা বাজার২৪। বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭: রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরব থাকায় সমালোচিত মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সমাধানের পথে হাঁটার আভাস দিয়েছেন। রাজধানী নেপিদোতে অনুষ্ঠিত ১৩তম এশিয়া-ইউরোপ বৈঠকের (আসেম) প্রথম দিনে গত সোমবার রোহিঙ্গা প্রশ্নে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। এর পরও ওইদিন বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি। বৈঠকের শেষ দিন গতকাল মঙ্গলবারও আলোচনায় স্থান পায় চলমান রোহিঙ্গা সংকট। পরে সংবাদ সম্মেলনে সু চি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে চলতি সপ্তাহেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হবে। আজ বুধবার ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি, এই আলোচনার ফলাফল হিসেবে শিগগির একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা যাবে। আর সেখানেই ঠিক করা হবে, যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, তাদের কীভাবে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা যায়। খবর ইউএনবি, রয়টার্স, দ্য টেলিগ্রাফ ও ডয়েচে ভেলের।
সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, এশিয়া ও ইউরোপের ৫১ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে আসেম সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিশ্বজুড়ে মানবিক সংকটের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের উৎস মিয়ানমার। এ কারণে বৈঠকের আয়োজক দেশ হিসেবে ঘুরেফিরেই আসে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। এ ছাড়া নিরাপত্তা, বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, দুই মহাদেশের নানা চ্যালেঞ্জ, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা হয়। একই সঙ্গে আগামী বছরের অক্টোবরে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত আসেম সামিট নিয়েও আলোচনা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। পরে ৩৬ দফার যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তবে এতে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি স্থান পায়নি। দুপুরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এবারের সম্মেলন শেষ হয়। এবারের থিম ছিল স্টেনদেনিং পার্টনারশিপ ফর পিস অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট।
আগস্টের শেষ দিকে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সোয়া ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ এই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গতকাল প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বলেছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের আচরণ জাতিগত বিদ্বেষমূলক।
মিয়ানমারের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল সু চি রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, এক রাতেই কোনো কিছুর সমাধান সম্ভব নয়। তবে ধারাবাহিক অগ্রগতি সম্ভব। বিশেষ করে এমন সংকটের মতো বিষয় যখন সামনে আসে। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি-না- সাংবাদিকের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এমনটা হয়েছে কি-না তা বলতে পারব না। তবে সরকারের দায়িত্ব হিসেবে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এবারও এ বিষয়ে কথা বলার সময় রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করেননি সু চি। যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ফিরিয়ে নিতে ১৯৯০ সালের চুক্তি অনুসরণ করা হবে বলে জানান তিনি। সু চি বলেন, তাদের বসবাসের অধিকারের ভিত্তিতে ফিরিয়ে নিতে চাই। এটি অনেক আগেই দুই দেশের সরকার মেনে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তির কতটা কাছাকাছি আছে, তা বলা খুবই কঠিন। মিয়ানমারের এই রাজনৈতিক নেত্রী দাবি করেন, রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্ভব সব কিছু করছে সরকার। সে জন্য সময় প্রয়োজন। কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি বজায় রাখার দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
একই সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি সেন মিক্সার। তিনি বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তির পথে অনেকটাই এগিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, শেষ পর্যন্ত চুক্তি হলে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ ভূমিতে ফিরতে পারবে।
এর আগে সোমবার সম্মেলনের সাইডলাইনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হয়। এশিয়া ও ইউরোপের ১৫টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন। একই সঙ্গে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপরও তারা জোর দেন। সেনাবাহিনীর অত্যাচারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানায় ইইউ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ওই অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন এবং সম্মেলনের ফাঁকে ইউরোপের কয়েকটি দেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন।
এসব বৈঠক সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল সময় টিভিকে জানান, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে সংকট সমাধানে সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে। তিনি জানান, অং সান সু চির সঙ্গে আজ বুধবার বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠকেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দ্বিতীয় দিনে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন। এ ছাড়া সাইডলাইনে তিনি মাল্টা ও নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাপানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এ সময় তারা স্বার্থসংশ্নিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা করেন।
যৌথ বিবৃতিতে নেই রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ :রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের প্রতিনিধিরা কথা বললেও ৩৬ দফা যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। যদিও তারা এই অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতি, সন্ত্রাসবাদ ও অপহরণের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলেন। বৈঠকে বিশেষ করে ভারসাম্যপূর্ণ, শক্তিশালী ও অধিক টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। আসেমভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ডিজিটাল যোগাযোগকে আরও কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়েও আলোচনা করেন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার অঙ্গীকার করেন তারা। এ ছাড়া এশিয়া-ইউরোপের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন বলে যৌথ ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্র: সমকাল