খােলা বাজার২৪।শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭: সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, আগামী বছর থেকেই দেশে আমদানি করা এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার শুরু হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, আগামী বছর এপ্রিল নাগাদ বাংলাদেশে এলএনজি আসবে। এই এলএনজি সাগরে অবস্থিত ট্রিটমেন্ট প্লান্টে ন্যাচারাল গ্যাসে রূপান্তর করা হবে। এর পর ওই গ্যাস আমাদের জাতীয় গ্রিডে অর্থাৎ পাইপলাইনে দেওয়া হবে। এপ্রিলে প্রথম দফায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস যোগ হবে। এতে গ্যাসের ঘাটতি কিছুটা হলেও কমে যাবে। কিন্তু নতুন এক সমস্যা দেখা গেছে। এই গ্যাস সরবরাহ করতে বিশেষ করে দুটি পাইপলাইনের কাজ এখনও অনেক বাকি। জ্বালানি মন্ত্রণালয় আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এ দুই পাইপলাইন যথাসময়ে প্রস্তুত না হলে আমদানি করা পুরো এলএনজি ব্যবহার করা যাবে না। এ গ্যাসের অভাবে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্প-কারখানা অলস বসে আছে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
দেশে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ ও সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করে থাকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড-জিটিসিএল। জ্বালানি বিভাগ বলছে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইন নির্মাণে বড় ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে জিটিসিএল। এগুলো হলো বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ এবং ধনুয়া-এলেঙ্গা গ্যাস পাইপলাইন। একটি প্রকল্পের কাজ ১০ বছরেও শেষ হয়নি। অন্যটির তিন বছরের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। জিটিসিএলের কাজের এই ধীর গতিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় হতাশ। সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী বছর আমদানি করা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হবে। এই পাইপলাইন প্রস্তুত না থাকলে আমদানির গ্যাস পুরোটা সঞ্চালন করা যাবে না। সূত্র বলছে, ফলে সরকারকে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিল্প-কারখানায় গ্যাস দেওয়াও সম্ভব হবে না।
জ্বালানি বিভাগের উপপ্রধান মো. আবু ইউসুফ মিয়া স্বাক্ষরিত দুটি পৃথক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের মেয়াদ ১০ বছর অতিক্রম করলেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। একইভাবে ধনুয়া-এলেঙ্গা গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ কাজ ২০১৪ সালে শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলতি মাসে প্রতিবেদন দুটি জ্বালানি বিভাগে জমা হয়েছে।
ওই দুই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের সফল সমাপ্তি প্রকল্প পরিচালকের যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মস্পৃহা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। এই প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। এতে নীতিনির্ধারণী সভায় বিবব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে এই দীর্ঘ সময় নেওয়া প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতার পরিচয় বহন করে।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী বছর থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হচ্ছে। এই এলএনজি ন্যাচারাল গ্যাসে রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। সরকার প্রথমেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই আমদানি করা গ্যাস সরবরাহ করতে চায়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শিল্প এলাকাতেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই এলএনজি দেওয়া হবে। এ জন্য এ দুটি পাইপলাইনের কাজ শেষ করা অত্যন্ত জরুরি।
সিদ্ধিরগঞ্জে সামিটের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস সংকটের কারণে জ্বালানি তেলে চলছে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সরকারকেও বেশি দামে এ বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এর বাইরে সিরাজগঞ্জে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এখন সংকট থাকলেও এলএনজি এলে সেখানে গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও খুলনাতে দ্বৈত জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোও বর্তমানে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সরকার চাইছে আগামী বছর এলএনজি আমদানি শুরু হলে প্রথমেই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবাহ করা হবে। এ জন্য ধনুয়া-এলেঙ্গা ও বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইনের প্রয়োজন পড়বে। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশের শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বাড়াতেও এ দুই পাইপলাইনের গুরুত্ব অনেক।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে পাইপলাইন নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে ওই দুই প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সংশ্নিষ্টরা দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেন। বৈঠকে প্রকল্প পরিচালকদের সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বৈঠকে জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ছাড়াও পেট্রোবাংলা এবং জিটিসিএলের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ এলাকার বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরাসরি গ্যাস দেওয়ার জন্য বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইনটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়। বাস্তবায়ন মেয়াদ ১০ বছর অতিক্রম করার পরও ২০ শতাংশ কাজ বাকি। পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার।
অন্যদিকে ধনুয়া-এলেঙ্গা পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের জুনে। শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০১৯ সালে। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের অগ্রগতি ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। ৯৭৯ কোটি টাকার এ পাইপলাইন নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো দেশের পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করা। ৬৬ কিলোমিটারের পাইপলাইনটিতে ৬টি নদী ক্রসিং রয়েছে।
জানতে চাইলে জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান বলেন, বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে প্রকল্পের ইআরপির (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট-সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) কাজ এখনও শেষ হয়নি। দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরির কারণে এ কাজ এখনও বাকি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ধনুয়া-এলেঙ্গা পাইপলাইনের ৬৬ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার বসে গেছে। বাকিটা আগামী বছরের মধ্যে বসানো শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।