Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৮: পদ্মা সেতু, বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ আসছে বিদেশ থেকে। চাল ও পেঁয়াজসহ ভোগ্যপণ্য আমদানিতেও ব্যয় বেড়েছে অনেক। যদিও এর বিপরীতে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হয়নি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় হচ্ছে দিন দিন। শুধু সদ্য বিদায়ী বছরের অক্টোবর পর্যন্ত চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৩৩১ কোটি ডলার। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের আমদানি ব্যয় যুক্ত হলে এ ঘাটতি ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের বিপরীতে প্রায় তিন গুণ বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়েই সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গত অর্থবছর শেষে ঘাটতি ১৪৮ কোটি ডলার থাকলেও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তা ৩৩১ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৮৭ কোটি ডলার ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে চলতি হিসাবে ৪২৬ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

চলতি হিসাবে বড় অংকের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় টান পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২০০১ সাল থেকে ক্রমবর্ধনশীল রিজার্ভ নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে এসেই হোঁচট খেয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অথচ ছয় মাস আগেও (২০১৭ সালের ৩০ জুন) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ডলার।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, হুন্ডি ও মানি লন্ডারিংয়ের কারণে গত দুই বছর রেমিট্যান্স আহরণে বিপর্যয় হয়েছিল। একই সময়ে কাঙ্ক্ষিত হারে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়নি। অন্যদিকে সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানিতে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। এ কারণে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

বিদ্যমান ঘাটতি অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহে বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ৬ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ কারণে বিদ্যমান ঘাটতি অচিরেই কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান মাধ্যম দেশের রফতানি আয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরজুড়ে খরা গেছে। ওই অর্থবছর রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ, যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশে রফতানি খাত থেকে আয় এসেছে ১ হাজার ৪৫৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। অথচ বাজেটে রফতানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

রফতানি আয়ের মতো রেমিট্যান্স প্রবাহেও বড় ধরনের উত্থান-পতন চলছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৬৯৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। তবে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়। বছরটিতে দেশে মোট রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলার। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৪২২ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।

দুই বছর ধরে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে বড় ধরনের টান পড়লেও উল্লম্ফন হয়েছে আমদানিতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশে ৩ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলারের। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে এলসি খোলার হার বেড়েছে ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ। একই সময়ে এলসি সেটেলমেন্ট বেড়েছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। ডিসেম্বর মাসের এলসি খোলা ও সেটেলমেন্ট যুক্ত হলে আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে।

আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডলারের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি আমদানি পর্যায়ে ১ ডলার কিনতে খরচ হতো ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ১ ডলার কিনতে ৮২ টাকা ৭০ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যের বিপরীত চিত্র এখন ডলারের বাজারে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর বেড়ে ৮৪ টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৮৫ টাকারও বেশি নিচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুধু গত ছয় মাসেই বাজারে ১০০ কোটির বেশি ডলার ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে উল্টো প্রতিদিনই ডলারের দাম বাড়ছে। এতে রফতানিকারকরা উপকৃত হলেও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে পণ্য আমদানিতে, যার প্রভাব পড়ছে ভোগ্যপণ্যসহ আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে। ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার বেচাকেনার অভিযোগে সম্প্রতি প্রায় ২০টি ব্যাংককে নোটিস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংককে এ ইস্যুতে জরিমানাও করা হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান বলেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমদানি পর্যায়ে ডলারের বিক্রয় মূল্য ৮৩ টাকার নিচে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তারপরও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলোর পক্ষে তা মানা সম্ভব হচ্ছে না।

সূত্র : বণিক বার্তা