Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

গোলাম মোর্তোজা – খােলা বাজার২৪। মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮:  ঢাকার পাশের নারায়ণগঞ্জকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে ‘ভয়ঙ্কর’ এবং ‘মজা’র ঘটনা ঘটে। হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির উপর আক্রমণটা ছিল দানবীয় পর্যায়ের ভয়ঙ্কর।

এই ভয়ঙ্কর আক্রমণের কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করলে, কিছু ‘মজা’র বিষয়েরও সন্ধান মেলে।

১.
নিয়াজুল নারায়ণগঞ্জের একজন পরিচিত ক্যাডার- সন্ত্রাসী।হাতে পিস্তল, পরনে জিনিসের প্যান্ট- জ্যাকেট।সাহসী সন্ত্রাসী স্টাইলে গুলি করতে এগিয়ে এলো মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির দিকে।মেয়র আইভির নিবেদিত প্রাণ নিরস্ত্র কর্মি বাহিনি মানব প্রাচীর তৈরি করলেন এবং নিয়াজুলকে বেদম পেটালেন। অস্ত্রধারী নিয়াজুল নিরস্ত্র আইভির কর্মিদের কাছে মার খেলেন। নিয়াজুলের গুলির টার্গেট থেকে বেঁচে গেলেন আইভি।

২.
শামীম ওসমানের নামের আগে- পরে বিশেষণ লেখার দরকার হয় না।তিনি কি- সবাই তা জানেন। নিয়াজুল বিষয়ক ঘটনার ‘মজা’র অংশ শামীম ওসমানের বক্তব্যে।

ক. ‘নিয়াজুলের বড় ভাইকে বিএনপি- জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। এটা কি তার অপরাধ?’

কোনো ক্রসফায়ার হত্যাকান্ড সমর্থন করি না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পিস্তল হাতে মেয়র আইভিকে গুলি করতে আসার সঙ্গে তার ভাইয়ের ক্রসফায়ারের সম্পর্ক কী? তার ভাইকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে বলে, সে আইভিকে গুলি করতে পারবে?

খ. ‘নিয়াজুল বিশাল মার্কেটের মালিক। সে কি পিস্তল নিয়ে রাস্তায় আসবে?’

বিশাল মার্কেটের মালিকের সঙ্গে পিস্তল নিয়ে বাইরে না আসার কি সংবিধিবদ্ধ কোনো নিয়ম আছে? নিয়াজুল সেই নিয়ম মেনে চলে?

কিসের সঙ্গে কি, মজার না বিষয়টি?

গ. ‘নিয়াজুল একা হেঁটে বাড়িতে যাচ্ছিল। আইভির লোকজন আক্রমণ করায়, সে পিস্তল বের করেছে।’

নিয়াজুলের ভিডিও চিত্র এবং শামীম ওসমানের বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করলে, ব্যাপক বিনোদনের সন্ধান পাওয়া যায়।

ঘ. ’নিয়াজুলের পিস্তল পরীক্ষা করা হোক, সে গুলি করেছে কিনা।’

বিষয়টি এমন, যেহেতু নিয়াজুল আইভিকে গুলি করতে পারেনি, সেহেতু এটা কোনো অপরাধ নয়। দারুণ মজার যুক্তি!

ঙ. ‘নিয়াজুলের পিস্তল কেড়ে নেয়া হলো কেন? পিস্তল কেড়ে নেয়া অপরাধ।’

পিস্তল দিয়ে গুলি করতে আসাটা অপরাধ নয়, সন্ত্রাসীর পিস্তল কেড়ে নেয়া অপরাধ!

চ. ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পরের ঘটনা আরও মজার। পুলিশকে কেউ একজন ফোন করে বলল, ঘটনাস্থলের আশেপাশে গিয়ে পুলিশ নিয়াজুলের সেই পিস্তল উদ্ধার করল।১০ টি গুলি ভর্তি পিস্তল, এতদিন পর উদ্ধার করা হলো। পিস্তলে যেহেতু ১০ টি গুলি ভর্তি, সেহেতু পুলিশ সিদ্ধান্তে পৌঁছাল পিস্তল থেকে গুলি করা হয় নি।

শামীম ওসমান বলেছিলেন ‘পরাক্ষা করা হোক’ পুলিশ পরীক্ষা না করেই বলে দিল ‘গুলি করা হয়নি’।১০ টি গুলি থেকে ২ টি বা ৫ টি বা ১০ টি গুলি করে, আবার গুলি ভরা যায়, এই অতি সাধারণ বিষয় বিবেচনায় নেয়া হলো না। গুলি করা হয়েছে কি হয়নি, পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।তার আগেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হলো। যা মিলে গেল শামীম ওসমানের ইঙ্গিতের সঙ্গে।

২.
মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির উপর আক্রমণ কতটা ভয়ঙ্কর ছিল, তা বোঝা গেছে ভিডিও চিত্র দেখে। এযাবকালে নারায়ণগঞ্জে যারা ওসমান পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছে, তাদের নারায়ণগঞ্জ ছাড়তে হয়েছে। ব্যতিক্রম নারায়ণগঞ্জের আরেক প্রভাবশালী চুনকা পরিবারের সন্তান সেলিনা হায়াৎ আইভি।ভয় দেখালে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা আইভি নারায়ণগঞ্জ অথবা রাজনীতি ছেড়ে দেবেন।

দলীয় নেতা- কর্মিরা তাকে ত্যাগ করবেন। অতীতের এই ফর্মূলা কাজ করেনি আইভির ক্ষেত্রে। ভয় দেখানোর ফল হয়েছে উল্টো। ভয়কে সত্যি সত্যি জয় করে ফেলেছেন আইভি। নারায়ণগঞ্জের নেতা-কর্মিরা চুনকার পরে, আর একজন সাহসী নেতা পেলেন। সেই নেতা চুনকার মেয়ে আইভি।নেতা কর্মিরা তার সাহস এবং সততার প্রতিদান দিয়ে পাশে থাকলেন, সঙ্গে থাকলেন। নিয়াজুলের গুলি থেকে রক্ষা করলেন। ওসমান পরিবারের হিসেব গড়মিল হয়ে গেল।

৩.
একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে,সেলিনা হায়াৎ আইভিকে ভয় দেখিয়ে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাজনীতি থেকে বা নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে দেয়া যাবে না। একারণেই মেয়র আইভির জীবন বেশি ঝুঁকির মূখে পড়েছে।নারায়ণগঞ্জে এবারই যে আইভির উপর আক্রমণ হলো, তা নয়। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ঢাকায় এসেছিলেন আইভি। সেই দিন তার গাড়ির চাকার ৬টি নাট খোলা পাওয়া যায়।

বিষয়টি ধরা পড়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার পর।কোনো হিসেবেই গাড়ির চাকার এতগুলো নাট এক সঙ্গে খোলা থাকার কথা নয়।বিষয়টি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পুলিশ তদন্ত করছিল। মজার বিষয় হলো, এখনও তদন্ত করছেই। রিপোর্ট আজও পাওয়া যায় নি। তার মানে বিষয়টি সেই পরিমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। যেভাবে গুলি করতে যাওয়া নিয়াজুলকে সঙ্গে সঙ্গে তো গ্রেপ্তার করা হয়ই নি, পরেও গ্রেপ্তার করা হয় নি।

৪.
হত্যা করতে যাওয়া নিয়াজুলদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আইভি। প্রথমাবস্থায় পুলিশ মামলাও করেনি। আইভির মামলাও তুলে নেওয়ার জন্যে অনবরত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন শামীম ওসমান। হত্যা করতে উদ্যত সন্ত্রাসী নিয়াজুলদের পক্ষে কথা তো বলছেনই। প্রায়ই শামীম ওসমান বলেন,আমি ডাক দিলে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। লক্ষ লক্ষ শব্দটি সম্ভবত শামীম ওসমানের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। কারণ লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন আইভির কাছে।

৫.
গাড়ির চাকার নাট খোলা থাকার পরও দূর্ঘটনা ঘটেনি, প্রাণে বেঁচে গেছেন মেয়র আইভি।শামীম ওসমানের ক্যাডার নিয়াজুলির গুলি থেকে বাঁচিয়েছেন তার কর্মিরা।অথচ বাঁচানোর দায়িত্ব ছিল পুলিশের। যে পুলিশ সেদিন দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এর জন্যে পুলিশকে জবাবদিহি করতে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। শামীম ওসমানের বেপরোয়া আচরণ আরও দৃশ্যমান হয়েছে।

সব কিছু মিলিয়ে নির্ধিধায় বলা যায়, মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির জীবন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে।সেদিনের আক্রমণের পর তার মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে।ঘটে যেতে পারত বড় দূর্ঘটনাও।

এর মাঝে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। ওবায়দুল কাদের নারায়ণগঞ্জে গিয়ে শামীম ওসমানের বাড়িতে যান নি, গেছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক নেতার বাড়িতে। সেখানে ছুটে এসেছেন শামীম ওসমান।এটা শামীম ওসমানের প্রতি বড় কোনো বার্তা কিনা, সেটা দেখার বিষয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় সেলিনা হায়াৎ আইভির জীবনের নিরাপত্তা।

মেয়র আইভির মত সাহসী এবং সৎ একজন রাজনীতিবিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং হত্যার প্রচেষ্টাকারী দৃশ্যমান- নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নির্বিকার থাকলে, ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে থাকলে, আইভির জীবন নিরাপদ থাকবে না। পরে আফসোস না করে, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তা না হলে মেয়র আইভিকে বাঁচানো যাবে না। ভাগ্য এবং কর্মিরা তাকে বারবার বাঁচাতে পারবেন না।

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com পরিবর্তন