সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা – খােলা বাজার২৪। শনিবার, ১৭ মার্চ ২০১৮ : জন্মালেই আমরা সবাই মানুষ হয়ে উঠি না। মানুষ হয়ে উঠতে হয়। আজ এক দিকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, দর্শন-মনন-প্রজ্ঞার অপরিসীম বিস্তৃতি, সমাজ-সভ্যতার দ্রুত সম্প্রসারণ, অন্য দিকে মানুষে মানুষে হিংসা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অভাবনীয় স্খলন-পতন-বিভেদ-বিদ্বেষ-বিপর্যয়-বীভৎস কার্যকলাপের উল্লাসে প্রচণ্ড ভাবে ব্যাহত শুভচেতনা, নৈতিক মূল্যবোধ।
বাংলার মেয়ে পৃথূলা জীবন দিয়েছে। সে উড়তে ভালবাসত। এটা শুধু উড়োজাহাজে উড়ান নয়, সে উড়তে ভালবাসতো উদ্দীপনার কৌলীন্যে। নেপালে গত সোমবারের যে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে তার কো-পাইলট ছিল পৃথূলা। তার জন্য ব্যাপক মানুষের হৃদয় থেকে ভালবাসার প্রকাশ যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু অমানুষের বমি উদগীরন। এদের ভাষা সভ্য জগতের উচ্চারণযোগ্য নয়।
যারা বলছে নারী পাইলট হওয়ায় এমনটা হয়েছে, বা নারী কেন পাইলট হয়েছে, বিশ্বাস করতে হবে এদের কাছে নিজেদের মায়েদেরও কোন সন্মান নেই, নিরাপত্তা নেই। পৃথিবীতে যত বড় বড় কাজ হয়েছে, তার মূলে আছে আত্মবোধ ও আত্মবিশ্বাসের জাগরণ। পৃথূলার অগ্নিময় আত্মবিশ্বাস ছিল। তাই সে তাকে গালাগাল দেওয়া নরকের কীটদের মতো জীবন কাটাতে চায়নি। তার জীবন ছিল ঐশ্বর্যে ভরা, তার মৃত্যুও হয়েছে পরার্থে জীবন উৎসর্গ করে।
ধর্ম নিয়ে আজ পৃথিবী সন্ত্রস্ত। মৌলবাদীদের আস্ফালন সর্বত্র। মানুষ বিপন্ন। পৃথূলাকে নিয়ে যারা আজ সামাজিক মাধ্যমে অসামাজিকতা করছে তারা জানেনা, কোন শর্ত ছাড়াই ধর্ম মানুষের বন্ধু হতে পারে। ধর্মের বিচারে আজ যারা নারীকে নিয়ে অপবাদ দেয় তারা কখনো নিরন্ন মানুষের জন্য অন্ন, অসুস্থ প্রপীড়িতের জন্য ত্রাণ-সেবা, অনাথ-বিধবার অশ্রুমোচনের দায়িত্ব নেয়নি, নেয়না।
এটি হলো নারীর প্রতি হিংসা ও আক্রমণ। এরা নারীর যেকোন কাজে, নারীর আচরণে ধর্ষনের আহ্বান দেখতে পায়। এই যে নারীকে তারা বিনামূল্যে সদুপদেশ দিচ্ছে কী ভাবে শরীর ঢাকবে, কিভাবে নারী চলবে, কোন কাজ করবে, কোনটা করবেনা, বা কোনটা কিভাবে করবে এসবই আসলে তার লাম্পট্য, লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য। সামাজিক মাধ্যমে নারীর উপর এই আক্রমণ করে আসলে এরা ধর্ষণের তৃপ্তি অনুভব করছে।
এরা প্রশ্রয় এবং নারীর উপরই আক্রমণের দায় চাপিয়ে তৃপ্ত বোধ করেন। উপায় তা হলে কী? টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসা ও আক্রমণ, চরিত্রহনন, পোশাক/আচরণবিধি, পেশা নিয়ে কটাক্ষ সবই চলছে অবিরত। ক্ষুব্ধ, অপমানিত আমরা মোমবাতি জ্বালব, মৌনমিছিল করব, সংবাদপত্রে বয়ান দেব, তার পর যথাসময়ে সব ভুলে কৃতজ্ঞতায় পুরস্কৃত করব হিংসার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থক ওই সব বিশিষ্টজনদের?
পৃথূলার প্রতি এই হিংসা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যারা সেক্যুলারদের গালি দেয় সেক্যুলাঙ্গার বলে এটা তাদের সংস্কৃতি। এই হিংসা সবার প্রতি নারীর প্রতি, উদারতার প্রতি। এই হিংসা আসলে এক ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’।
নারীর শ্রমে পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব সেরাদের এক দেশ। ইদানীং এই দেশ হতে রফতানি হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক ভাব আর তাহলো নারী হিংসা। তারা এদেশে বসে পাশ্চাত্যের আবিষ্কার ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে এই হিংসা প্রচার করছে, আবার সেই পাশ্চাত্য দেশেই উন্নত জীবন উপভোগ করে বিজ্ঞান বিরোধী, মানবিকতা বিরোধী, নারী বিরোধী মতামত সগৌরবে প্রচার করছে। তাদের মনোজগতে এই ভাবনার শিকড় অনেক গভীরে।
সামাজিক মাধ্যমে এই যে আগ্রাসন, এর একটি বৈশিষ্ট্য হল, অনেক নারীও এসবে সমর্থন দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো একে অন্যায় হিসাবেই মনে করছেনা সমাজের বড় অংশ। সমাজের এই অনুমোদন ভয়ংকর।
এই হিংসা এক ধরণের ব্যাধি, গুরুতর ব্যাধি। এই ব্যাধি শনাক্ত করা কঠিন। বাড়িতে বাড়িতে, পাড়ায় পাড়ায়, অফিসে অফিসে, বাসে, রেলে মেয়েদের প্রতি অবিরাম চলছে মৌখিক অত্যাচার। এতটাই বেশি হচ্ছে যে এসব অত্যাচারকে অনেকেই নিপীড়ন বলে চিনতেই পারেননা। হিংসা চলে প্রেমের বা যৌনতার ছদ্মবেশেও। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটের এই প্লাটফর্ম। সামাজিক মাধ্যমে এসব হিংসার প্রকাশ কেবল নারীকে নয়, তার চারপাশকে, তার মা, বাবা, ভাই, বোন, সন্তানসহ প্রিয়জনদেরও মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত করছে।
আমার একটা ভয় কাজ করে। কিশোর বয়সের যারা সামাজিক মাধ্যমে বিচারণ করতে শুরু করেছে, তাদের নিয়ে ভাবনাটা বেশি। এরা ভাবতে পারে এত শিক্ষিত বা বড় অবস্থানে থাকা মানুষজন যখন বলছে, সমাজ যখন সইছে, তখন এধরনের হিংসার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই।
তারাও নারীদের প্রতি এমন ধারণার ছায়াতেই এগিয়ে যেতে পারে। এভাবে হিংসা ক্রমান্বয়ে, প্রজন্ম হতে প্রজন্মে, নিজেকে পুনঃসৃজন করে চলবে। এই প্রবণতা পরিত্যাগে পরিবারে পরিবারে নারীসম্মানে শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। হতোদ্যম নয়, নারীকে এগুতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তির পথেই। তবেই সে এই নিগ্রহ হতে মুক্তি পেতে পারে। আর সেই আবহ গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।
[email protected]