Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements


খােলা বাজার২৪। সোমবার ২৫ জুন ২০১৮ :  গত কয়েক মাসে সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকদের নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসার রেকর্ড হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ নির্যাতিত হয়ে ফিরছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে ফেরত আসা নারীদের অনেকে বলেছেন, দেশে যদি ভিক্ষা করেও খেতে হয়, খাবেন; তার পরও সৌদিতে আর কাজের জন্য যাবেন না। কারণ সেখানে মানসম্মান নিয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার সব জানার পরও নারীদের কেন সৌদি আরবে কাজের জন্য পাঠাচ্ছে। এ প্রশ্নটি শুধু ফেরত আসা নির্যাতিত শ্রমিকদেরই নয়, তাদের মতো অনেকের মনেও এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। এই নির্যাতিত নারীদের মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে যে কেউ-ই অনুধাবন করতে পারে, কতটা বিপত্সংকুল অবস্থা থেকে তারা মুক্তি লাভ করেছে।

দীর্ঘদিন থেকেই বিদেশে নারী শ্রমিকদের নানা ধরনের নির্যাতনের খবর পাই। এ সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে পড়েনি। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে প্রায় এক হাজার নারী শ্রমিক দেশে ফিরে আসার তথ্য রয়েছে। ফিরে আসা নারীদের অনেকেই সৌদি নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। প্রায়ই এমন সব অভিযোগের ইস্যু গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারি এবং ব্যথিত হই। গত বছর ২৪ জানুয়ারি কালের কণ্ঠে ‘মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কেঁদে ফিরছেন নারীকর্মী’ শিরোনামে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনে নির্যাতনের কিছু বাস্তব চিত্র দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। এরপর নানাভাবে এ ধরনের প্রতিবেদন আমাদের শঙ্কিত করছে প্রতিনিয়ত। এ বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস অব্যাহত থাকলেও নারীরা এখনো না বুঝেই বিদেশে যাচ্ছে। এর আগে এ ধরনের ইস্যুতে অনেকবার আমাদের কান ভারী হলেও কেন এর স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না এটি এখন বড় প্রশ্ন।

গৃহকর্মীর অভাবে চারদিকে হায় হায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সৌদি সরকার বাংলাদেশকে নারী গৃহকর্মী প্রেরণের প্রস্তাব দেয়। এর আগে বাংলাদেশকে মোচড় দেওয়ার এক অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে। নতুন কোনো বাংলাদেশি (পুরুষ) শ্রমিকের নিয়োগও সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের একটা বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে এপ্রিলের মাঝে ৯ সদস্যের এক সৌদি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সে প্রস্তাব লুফে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, প্রতি মাসে হাজার দশেক গৃহকর্মী নেবে সৌদি আরব। বাজারে রটিয়ে দেওয়া হয়, সৌদি শ্রমবাজার খুলে গেছে। নারী দিয়ে শুরু হবে, পুরুষরাও যাবে পরে। এভাবে কৌশলে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে সৌদি সরকার। আর যারা কৌশল করে তাদের দ্বারা স্বার্থের জন্য যেকোনো কিছু করা অসম্ভব নয়।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার। দেশের রেমিট্যান্স আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ আসে সে দেশ থেকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী এই দেশটির বদনাম রয়েছে গৃহপরিচারিকাদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক যায়। আবার নানা কারণে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগে সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি নারী ফেরত আসে। এসব নির্যাতনের মাত্রা বিবেচনায় ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কিছু দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। অথচ বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে (নারী শ্রমিক পাঠানোতে) একধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে।

বাংলাদেশ এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে। আর মধ্যম আয়ের দেশের তকমা তো লেগেই আছে। দেশের এই উল্লেখযোগ্য সফলতার প্রবেশদ্বারেও চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়ে সৌদি আরব যাচ্ছে গৃহকর্মীরা। আবার ফেরত আসছে পলিথিনভরা কয়েকটি ছেঁড়া কাপড় নিয়ে।

বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজব্যবস্থায়ই গৃহকর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ, সমাজ যথেষ্ট এগিয়েছে। কোনো ব্যক্তি না খেয়ে জীবন যাপন করছে—এমনটা এখন আর দেখা যায় না। সরকারের নানাবিধ উদ্যোগে সমাজের হতদরিদ্ররা এখন নিয়মিত খাবার পায়। খাবারের অভাবে কাউকে খুব বেশি কষ্ট পেতে হয় না। তবু কিছু মানুষ বিশেষ করে নারীরা, যারা নিজেদের জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু এর ফল খুব বেশি কল্যাণকর হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা নির্যাতিত হয়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফেরত আসে, পরবর্তী সময়ে যারা সমাজে নিগৃহীত হয়। এই নিগৃহীত নারীদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা বাস্তবিক অর্থে নেই।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে নারীর অবস্থানগত উন্নতি সাধনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সূচকে পরিবর্তন এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ থাকলে ওই সব নির্যাতিত নারী সমাজে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। একদিকে তাদের নির্যাতনের কোনো প্রতিকার নেই, অন্যদিকে তাদের পুনর্বাসনব্যবস্থাও নেই; তাহলে তাদের ভাগ্য কিভাবে নির্ধারিত হবে—এমন বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রতারিতদের জীবনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমাদের সমাজের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

এরই মধ্যে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে চুক্তির পাশাপাশি কোনো নারী শ্রমিক নির্যাতিত হলে তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসে সেইফ হোম খোলা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কয়েক হাজার নারী শ্রমিক নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসার ঘটনায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীতিগতভাবে বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর বিরোধিতা নয়; বরং এর যৌক্তিকতা বিবেচনার তাগিদ অনুভব করার বিষয়টি এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন সভ্য দেশে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কাজ করছে। কাজেই ঝুঁকিপূর্ণ কোনো দেশে আমরা আমাদের নারী শ্রমিকদের পাঠাব কি না তা সময় থাকতে ভাবতে হবে।