খােলাবাজার২৪,শুক্রবার,২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ঃ এক দশকেরও বেশি সময় পর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের প্রতীক্ষায় দেশবাসী। ভোটারদের চাওয়া প্রচার-প্রচারণা অসম হলেও এবারের ভোটটা যেন সুষ্ঠু হয়। ভোট কি সুষ্ঠু হবে, নাকি ১৪ জানুয়ারির মতো প্রহসন হবে? এ প্রশ্ন এখন মানুষের মনে।
বাংলাদেশ সবশেষ জাতীয় নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ওই নির্বাচন কোনো বিচারেই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় দেড় শতাধিক আসনে আগেই ওয়াকওভার পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। ফলে নির্বাচনটা ছিল অনেকটা আইওয়াশ।
ওই নির্বাচনের পর দেশে বেশ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়। সেগুলোও ত্রুটিমুক্ত হয়নি। ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট-এসব ছিল ওইসব ভোটের চিত্র।
এতসবের পরও প্রায় এক দশক পর এবার একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ভোটের আশা করেছিল দেশবাসী। কিন্তু ভোটের মাঠে সব দল সমতল ক্রীড়াভূমি না পাওয়া এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর হামলা-প্রচারে বাধা, ভয়ভীতি প্রদর্শন এসব এবারের ভোট-পূর্ববর্তী ভোট উৎসবকে কালিমালিপ্ত করেছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০-দলীয় জোটসহ বিরোধী শিবির শেষ পর্যন্ত আশায় ছিল সেনাবাহিনী মাঠে নামলে সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে। ধরপাকড় কমবে। ভোটাররা স্বস্তি পাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও হয়নি বলে অভিযোগ বিএনপি নেতাদের।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচন-পূর্ববর্তী কার্যক্রমে মোটেও যে সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি, সেটি শিশু পর্যন্ত বলবে। হাজারো অভিযোগ গেলেও তারা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে দায় সেরেছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাখাওয়াত হোসেন বিদেশি একটি গণমাধ্যমে বলেন, বিগত কয়েকটি নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে তুলনা করলে, এবারে একটা ব্যবস্থাপনাহীন প্রচার চলেছে।
প্রচারের সংঘাতের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এবার অব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা ক্যাম্পেইন চলছে। এক পার্টি অনেক আগে থেকেই ক্যাম্পেইন শুরু করে দিয়েছে, রুলিং পার্টি। প্রতিপক্ষ পার্টির কিন্তু সে রকম কোনো প্রচার দেখা যায়নি। ক্যাম্পেইন পিরিয়ডে যা হওয়ার কথা নয়, সেসব হয়েছে।
তিনি বলেন, 'কোড অব কন্ডাক্ট' বলতে যে জিনিসটা আছে, সেটি একেবারে অসাড় হয়ে গেছে। সরকারি টিভিতে একটা প্রোগ্রাম করে যে যার বক্তব্য তুলে ধরত । ২০০৮ সালে এটি হয়েছে। সেই বক্তব্য কিন্তু এবারে দেখছি না। কাজেই সব মিলিয়ে একটা অস্বাভাবিক ক্যাম্পেইন পিরিয়ড আমরা দেখলাম।
এদিকে সংঘাত-সহিংসতা আর প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, প্রচারে বাধার পাঁচ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বিএনপির ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, ১৪-দলীয় জোট, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলও একই অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন ঘিরে কয়েকটি জেলায় হামলার শিকার হয়েছেন বলে বুধবার কমিশনে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারাও।এ নির্বাচন ভণ্ডুল করার মতো গুরুতর অভিযোগ একে অপরের বিরুদ্ধে তুলেছেন বড় দুদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, এসব অভিযোগের বেশিরভাগই পুলিশ ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে কমিশন। এ পর্যন্ত প্রশাসন ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিজ কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ ছাড়া অর্ধশতাধিক অভিযোগ তদন্ত করার জন্য নির্বাচন তদন্ত কমিটির কাছে পাঠিয়েছে ইসি। এর মধ্যে বেশিরভাগ অভিযোগের সত্যতা পায়নি বলে জানিয়েছে কমিটিগুলো।
নির্বাচনের প্রতীক পাওয়ার পর থেকে টানা ১৮ দিন বিরামহীন প্রচার চালানোর পর আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেয়া প্রচারের সময়সীমা শেষ হয়। ‘বিরামহীন প্রচার’ কথাটি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে খাটলেও এবার বিরোধী দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এটি সম্ভবত যায় না।
কারণ বহু আসনে ধানের শীষ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ঠিকমতো প্রচার চালাতে পারেননি। কোনো কোনো আসনে তো খোদ প্রার্থীকেই হামলার শিকার হতে হয়েছে গণসংযোগ করতে গিয়ে। কোনো কোনো আসনে প্রার্থী প্রচারেই নামতে পারেননি মামলা ও হামলার কারণে। আবার ধানের শীষের বেশ কজন প্রার্থীকে জেলে বসেই নির্বাচন দেখতে হচ্ছে।
এগুলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে ম্লান করেছে নিঃসন্দেহে। তবু ভোটারদের আশা দিনশেষে ভোট যদি সুষ্ঠু হয়! বেশিরভাগ আসনেই এমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, অনেকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। অনেক ভোটার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন ‘অযথাই’ ভোটকেন্দ্রে যাব কেন?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে রীতিমতো রক্তের হোলি খেলা হয়েছে, এমন অভিযোগ বিরোধী রাজনৈতিক দলের। প্রচারে গিয়ে অন্তত ৫০ প্রার্থী হামলার শিকার হয়েছেন। গুলিবিদ্ধও হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ রক্তাক্ত জখম হয়েছেন।
এত বাধা এত বিপত্তি দেশের কোনো নির্বাচনে হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। গত ১০ বছর ধরে যারা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটের আশায় ছিলেন, অসম প্রচারে তাদের হৃদয়ে আজ রক্তক্ষরণ।
যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। তবে ভোটারদের মনে যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে, তা অস্বীকার করাটা কঠিন।
যাই হোক, আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরই শুরু হয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত ভোটপর্ব। ভোটাররা সেই প্রতীক্ষায় আছেন। তারা ভোটের মাধ্যমে রায় দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য কোনো একটি দল/জোটকে ক্ষমতায় বসাবেন।
৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২৯৯ আসনে টানা ভোটগ্রহণ চলবে। এর পরই ফল প্রকাশ করা হবে।
প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোটগ্রহণ পিছিয়ে গেছে। এ নির্বাচনের ফলে নির্ধারিত হবে আগামী দিনে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট সরকার গঠন করবে। এদিন ভোট দেয়ার সুবিধার্থে সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।এ নির্বাচনে নতুন প্রায় এক কোটি ২৩ লাখ ভোটার প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবেন।
এদিকে ১০ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি হয়েছে। এবার নিবন্ধিত সব (৩৯টি) রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ৮০০-এর বেশি প্রার্থী।
এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী প্রায় এক হাজার ৭৫০ জন। বাকিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী অংশ নেয়ায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল বর্জন করেছিল।
এবার সব দল অংশ নেয়ায় সারা দেশে নির্বাচনী আবহ বিরাজ করছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের বিস্তর অভিযোগ করেছে।
পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির। একই অভিযোগ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, বাম রাজনৈতিক মোর্চাসহ আরও কয়েকটি দল।
ফলে এবারের ভোট ঘিরে উৎসবের পাশাপাশি শঙ্কাও বিরাজ করছে। বিএনপি, ২০-দলীয় জোটের শরিক ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার ৩০০ আসনে ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার। এতে ৪০ হাজার ১৮৩ ভোটকেন্দ্র ও ২ লাখ ৬ হাজার ৪৭৭ ভোটকক্ষ রয়েছে।
এবারই প্রথম ছয়টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হবে। যদিও এ মেশিন ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ভোটগ্রহণ কাজে নিয়োজিত থাকবেন প্রায় সাত লাখ কর্মকর্তা। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছয় লাখের বেশি সদস্য।
এরা ভোটের দিনে কতটা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখে এবং ভোট কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় সেটি দেখতে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে দেশবাসীকে।