খােলাবাজার ২৪, মঙ্গলবার, ০৯ এপ্রিল ২০১৯ঃ বগুড়া শহরের সুত্রাপুর এলাকায় মালেকা নার্সিং হোমে টনসিল অপারেশনের সময় হুমাইরা আকতার নামে ৬ বছর বয়সী এক শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছে। অপারেশনের বিল আদায় ও চার ঘন্টা অভিনয়ের পর সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে চিকিৎসকরা শিশুর লাশ সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের হাসপাতালে রেফার্ড করেন।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নলকা কায়েমগ্রামের কৃষক হারুনার রশিদের মেয়ে হুমাইরা আকতার স্থানীয় কায়েমগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়ত। তার টনসিলে সমস্যা হলে গত দুদিন আগে বগুড়া শহরের শেরপুর সড়কে সুত্রাপুর এলাকায় মালিকা নার্সিং হোমে আনা হয়। সেখানে ওই শিশুকে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. সাইদুজ্জামানকে দেখান।
শিশুর মামা আলমগীর তালুকদার জানান, ওই চিকিৎসক সোমবার বিকাল ৩টায় অপারেশনের সময় ধার্য করেন। অপারেশন ফি ধরা হয় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। সোমবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে হুমাইরাকে ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়। বিকাল ৩টায় তাকে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নিলে আধা ঘন্টা পর ডা. সাইদুজ্জামান ভেতরে ঢোকেন।
বিকাল ৪টায় চিকিৎসক বাহিরে এসে জানান, অপারেশন সাকসেসফুল, রোগীকে বেডে দেয়া হবে। এরপর নার্স ও বয়রা হুমাইরাকে বেডে দিয়ে যায়। কিন্তু হুমাইরার পালস্ না থাকা ও শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয়ায় স্বজনদের সন্দেহ হয়। তারা চিকিৎসক ও নার্সকে বিষয়টি জানালে তারা কর্ণপাত না করে জানান, রোগী ভালো আছে শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে। এর আগেই অপারেশন ফি আদায় করা হয়। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত জ্ঞান না ফেরায় স্বজনরা অস্থির হয়ে ওঠেন। অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসক জানান, রোগীর অবস্থা ভাল নয়; তাকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে।
এ বলে চিকিৎসকরা তড়িঘড়ি রেফার্ড করেন। শিশুকে সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাবার আগে স্বজনরা নিশ্চিত হবার জন্য প্রথমে বগুড়া শহরের মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নেন। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কোনো মন্তব্য করেননি। তারা শিশুটিকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে নেয়ার পর চিকিৎসক ইঙ্গিতে বোঝান হুমাইরা মারা গেছে। এরপর বাবা হারুনার রশিদ, মা সাহেদ ও মামা আলমগীর শিশুর লাশ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মালেকা নার্সিং হোমে ফিরে আসেন। ভুল অপারেশনে শিশু মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে বিক্ষুব্ধ জনতা ক্লিনিকে সামান্য ভাংচুর করেন। এ সময় চিকিৎসক, নার্স, ক্লিনিকের ম্যানেজার ও অন্যরা বাতি নিভিয়ে পালিয়ে যান। কেউ কেউ ক্লিনিকের ভেতরে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকেন। খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ ক্লিনিকে আসে। ওই সময় রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সে শিশু হুমায়রা আকতারের নিথর দেহ পড়েছিল।
পাশে বাবা-মা আহাজারি করছিলেন। মা সাহেদা শুধু আহাজারিতে সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, ভুল চিকিৎসায় তার বুকের মানিককে মেরে ফেলা হয়েছে।
একই দাবি করেন, শিশুর মামা আলমগীর তালুকদার।
তিনি বলেন, ভুল অপারেশনের সময় তার ভাগনীর মৃত্যু হলেও চিকিৎসক ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ চার ঘন্টা তাদের সঙ্গে অভিনয় করেন। শিশু বেঁচে আছে; শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে বলে ক্লিনিকের বিলও আদায় করেন। এরপর সকলে পালিয়ে যান। এমনকি রোগীর সঙ্গে দেয়া চিকিৎসাপত্র ও রেফার্ড লেটার গায়েব করে দেয়া হয়েছে।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে ওসি এসএম বদিউজ্জামান এবং ওসি (তদন্ত) কামরুজ্জামান মিয়া ক্লিনিকে ঢোকেন। এ সময় তারা পুরো ক্লিনিক খুঁজে শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসক রাফি হাসানকে পান।
ডা. রাফি জানান, এ ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ও ম্যানেজার বেলাল হোসেন। তবে তিনি তাদের ফোন নম্বর জানেন না। তিনি রাতে কাজে আসার পর জানতে পেরেছেন, ডা. সাইদুজ্জামান এক শিশুর টনসিল অপারেশন করেছেন। শিশুর অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। এর বাহিরে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। এনেসথেয়েটিস্ট কে ছিলেন তাও তিনি জানেন না। ফোন বন্ধ রাখায় ডা. সাইদুজ্জামান ও অন্যদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। রাত ১টার দিকে সদর থানা পুলিশ শিশুর লাশ উদ্ধার করেন।
ওসি এসএম বদিউজ্জামান জানান, শিশুর পরিবার মামলা দিলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ চলে যাবার পর ক্লিনিকের গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা চিকিৎসক ও অন্যরা হেলমেট পরে বাইকে দ্রুত সটকে পড়েন। তবে কিছু প্রভাবশালী ঘটনাটিকে চাপা দিতে ও ভুল অপারেশনকারী চিকিৎসক এবং অন্যদের বাঁচাতে তদবির করছিলেন।
বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীরা জানান, এর আগেও এ ক্লিনিকে মুসলমানী ও টনসিল অপারেশন করতে গিয়ে দুটি শিশু মারা গিয়েছিল। এরপরও কর্তৃপক্ষ বহাল তবিয়তে ক্লিনিক পরিচালনা করে আসছেন।