শুক্র. মার্চ ২৯, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার২৪, শুক্রবার ১৪ আগস্ট, ২০২০: দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। কখনো এর সঙ্গে যুক্ত হয় অনুদানও। ঋণ ও অনুদানে চুক্তি হলেও তার অর্থছাড় যথাযথভাবে হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছরই বাড়ছে অছাড়কৃত অর্থের পরিমাণ। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে এভাবে পাইপলাইনে আটকা পড়েছে ৪৯ বিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলার, যার পরিমাণ চলতি অর্থবছরের বাজেটের কাছাকাছি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করলে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, সেই পরিমাণ অর্থছাড় করে ঋণদাতা দেশ বা সংস্থাগুলো। কিন্তু দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে পারে না সরকার। ফলে যথাসময়ে অর্থছাড়ও করে না দাতারা। কাজের মানে অস্বচ্ছতা থাকলেও অর্থছাড়ে জটিলতা তৈরি হয়। দাতা দেশ বা সংস্থাগুলোর জটিল নিয়মের কারণেও অনেক সময় অর্থছাড়ে দেরি হয়।

বিষয়গুলো নিয়ে অনেক আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছে, কিন্তু সমাধান হচ্ছে না অভিযোগ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সক্রিয় থাকতে হবে, তবেই ঋণের অর্থের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব। যথাযথভাবে বিদেশি ঋণ বা অনুদান ছাড় করাতে না পারলে তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে পাইপলাইনে আটকে থাকা এসব অর্থছাড় করাতে বিশেষ কোনো উদ্যোগও নেই সরকারের পক্ষ থেকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ফাবা অ্যান্ড আইসিটি অনুবিভাগের উপ-সচিব সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘একটা প্রকল্পের কাজ শেষ হতে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। এই পাঁচ বছর ধরেই সেই প্রকল্পে অর্থছাড় হয়।’

তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঋণচুক্তি হয়েছে ৯ হাজার ৫৫৪ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলারের। এ অর্থবছরে মোট (২০১৯-২০ অর্থবছর ও তার আগের অর্থবছরগুলোসহ) ছাড় হয়েছে ৭ হাজার ২৭১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ অর্থবছরে আটকা পড়েছে ২ হাজার ২৮২ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন বা ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) চুক্তি হয়েছিল ৯ হাজার ৯০৩ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলার এবং মোট ছাড় হয়েছিল ৬ হাজার ৫৪২ দশমিক ৪৯৮ মিলিয়ন ডলার। সে অর্থবছরে আটকা পড়ে ৩ হাজার ৩৬১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন বা ৩ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রতি অর্থবছরেই ২ থেকে ৩ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ-অনুদান পাইপলাইনে আটকে যাচ্ছে। এভাবে আগের বিভিন্ন অর্থবছরে আটকা পড়া অর্থ মিলিয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত পাইপলাইনে আটকা আছে ৪৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি ঋণ ও অনুদান।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা প্রত্যেক বছরই বাড়ছে। প্রত্যেক বছর আনডিজবার্সমেন্ট (বিদেশি ঋণ ছাড় না হওয়া) বাড়ে। এর কতগুলি কারণ আছে। এগুলো অনেক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছে না। কিছুটা কারণ যারা ঋণ দেয়, তাদের কিছু জটিল নিয়মের ব্যাপার আছে বা অনেক সময় ডিজবার্সমেন্টের অনুমোদন হেড অফিস থেকে আসতে সময় লাগে, সে কারণে সময়ক্ষেপণ হয়। দ্বিতীয় যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা সময়মতো ঋণ ব্যবহার করতে পারি না। নিয়ম হচ্ছে আমরা কাজ করবো, সেই কাজের ভিত্তিতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে, সেটা ডিজবার্স করবে দাতারা। তো কাজ যদি না হয় ডিজবার্সমেন্টও হয় না। আমরা এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) তো ব্যবহার করতে পারি না। প্রত্যেক বছরই তো এডিপির বড় অংশ আনইউটিলাইজ (অব্যবহৃত) থেকে যায়। তো প্রত্যেক বছরই জমছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ নিতে সময়কাল বেশি লাগলে তখন ইন্টারেস্ট (সুদ) লায়াবেলিটিটা বেড়ে যায়। ওটা ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে উপকার হতো এবং সেই উপকার থেকে অর্থনীতি বঞ্চিত হচ্ছে।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে দুই দিনে একাধিকবার ফোন করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব ঋণ বা অনুদানের জন্য সরকার চুক্তিবদ্ধ হয়, সেসব প্রকল্প যদি বাস্তবায়ন না হয়, অসম্পূর্ণ থাকে, তাহলে তো সেখানে ঋণ ছাড় হবে না। সেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে, অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, তখন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সেটার জন্য যে চাহিদা বা প্রাপ্য, সেটা চাইতে হবে। যেসব ঋণচুক্তি বা যেসব প্রকল্পে ঋণ বা অনুদান হচ্ছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে সেসব ঋণ পাইপলাইনে থাকার পরও আমরা পাচ্ছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কাজ শেষ করে ঋণ পাননি, এরকম তো কোনো প্রকল্প নেই। বা কাজে যদি অনিয়ম, দুর্নীতি থাকে বা তার যদি সেসব শর্ত দেয়া থাকে, সেসব শর্ত যদি পূরণ না করতে পারেন, তাহলে তো ঋণ পাওয়া যাবে না।’

হারুনুর রশীদ বলেন, ‘টাস্কফোর্স সাধারণত গঠন করা হয়, যেগুলোর ঋণ পাইপলাইনে আছে, প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, কাজ চলছে, কিন্তু ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে যে, কী কারণে পাওয়া যাচ্ছে না, কোন কোন প্রকল্প কত দূর বাস্তবায়িত হয়েছে। এ সংক্রান্ত এখনো কোনো মিটিং বা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, তা আমার জানা নাই।’

করোনার এ সময়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে আটকে থাকা অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটে বড় একটা ঘাটতি আছে। এটা পূরণ হবে বৈদেশিক ঋণ দিয়ে। তাই বিদেশি অর্থছাড়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। সরকারকে বাইরের অনুদান, ঋণগুলো আনতে হবে। এটার জন্য ওরা কতগুলো শর্ত দিয়ে থাকে। শর্তগুলো পালন করতে হবে। শর্তগুলো হয়- প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো হতে হবে, মান ভালো হতে হবে, সুপারভিশন ভালো হতে হবে, ঠিক পথে এগোচ্ছে কি না – এগুলো সন্তুষ্ট করতে হবে। এগুলো করেই দাতাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। এই শর্তগুলো পালন করলে ওরা দেবে। তবে আমাদের দরকার, প্রকল্পগুলোর দ্রুত অগ্রগতি, সন্তোষজনক অগ্রগতি ও মান বজায় রেখে সময়মতো যেন ইস্যু করে। তবেই কিন্তু ডিজবার্স তাড়াতাড়ি হবে। নাহলে এগুলো ডিফিক্যাল্ট (জটিল) হবে। আর যদি না আসে, তাহলে আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যদি আমরা বাস্তবায়ন না করতে পারি সময়মতো।’