বৃহঃ. অক্টো ১০, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
স্বর্ণ চোরাচালানের দুই মাফিয়া ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিলীপ কুমার আগরওয়ালা এবং ডায়মন্ড অ্যান্ড ডিভার্সের মালিক এনামুল হক খান ওরফে দোলনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সূত্র জানান, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের হুন্ডি ব্যবসা ও সোনা চোরাচালানের সহযোগী হলেন এনামুল হক খান দোলন। অন্যদিকে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার সিন্ডিকেট গত পাঁচ বছরেই দেশ থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য      কমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে স্বর্ণ ও অর্থ পাচার ছাড়াও রয়েছে খুনের মামলা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডায় ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে শিবচরের সন্ন্যাসীর চর এলাকার হৃদয় হোসেন শিহাব নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের দিলীপ আগরওয়ালাসহ ১৬১ জনের নামে মামলা করা হয়। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে। ২২ আগস্ট বাড্ডা থানায় শিবচর পৌরসভার সাবেক কমিশনার শাহাদাত হোসেন খান মামলাটি করেন। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্বর্ণ চোরাচালান রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনার খুনের ঘটনাটি ঘটে। চাঞ্চল্যকর ওই খুনের ঘটনার তদন্তেও বেরিয়ে আসে দিলীপ আগরওয়ালার নাম। স্পর্শকাতর দুই মামলার আসামি হলেও তাঁরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালনের মাফিয়া এনামুল হক খান দোলন বিগত সরকার আমলে শেখ সেলিমের অবৈধ কারবারের সহযোগী ছিলেন। শেখ সেলিমের হয়ে বিদেশে অর্থ পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালান করতেন। দুবাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে তাঁদের চোরাকারবারের সিন্ডিকেট রয়েছে; যা এখনো সক্রিয়।
সূত্র জানান, নামে-বেনামে বেশুমার সম্পত্তি থাকার পরও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয় বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে। যাঁর বিরুদ্ধে সোনা, হীরা চোরাচালানসহ বিস্তর অভিযোগ। দেশে বিদেশে হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকা এ ব্যক্তিকে দায়মুক্তি দেন দুকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কমিশন। ২০২১ সালের ১০ মার্চ ইকবাল মাহমুদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের পাঁচ মাসে নিষ্পত্তি হওয়া ৪০৮টি নথি নতুন করে তদন্ত শুরু করছে দুদক। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালাসহ ৪ শতাধিক ব্যক্তির বেশুমার দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে দুদক কমিটিও গঠন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাই কোর্ট যে ৪০৮ মামলার নথি তলব করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার মামলা ও অভিযোগ। দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের অবসরে যাওয়ার মাত্র পাঁচ মাসে মামলা দায়ের ও অতিদ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করা সব মামলার নথি তলব করেছেন হাই কোর্ট। প্রতিবেদন আকারে মামলাগুলোর নথি দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওইসব নথির মধ্যে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের এমডি দিলীপ কুমার আগরওয়ালার নথি রয়েছে। ওই নথির তথ্য এবং দুদকে জমা হওয়া অভিযোগমতে মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। ’৯০-এর দশকে ঢাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। অল্প সময়ের ব্যবধানে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের দিলীপ নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের বিপুলসংখ্যক শোরুম। তাঁর সামগ্রিক উপার্জনের বৈধতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগে বলা হয়, মূলত সোনা ও হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন তিনি। তা ছাড়া দিলীপের বৈধ আয়ের চেয়ে অবৈধ সম্পদের পরিমাণই বেশি। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে সোনা এবং হীরা চোরাচালান ও বিদেশে অর্থ পাচারের ব্যাপক তথ্য পাওয়া যায়। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিলীপ কুমার আগরওয়ালার পাহাড়সম সম্পদ শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে। রাজধানীর গুলশানে একটি হোল্ডিংয়েই তাঁর নামে কেনা হয় সাতটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া দেশের বাইরে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে পান্না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, ২৫৩ রবীন্দ্র সরণি, বিবেকানন্দ রোডের বড়বাজার, ধর্মতলার গোল্ডেন মল, ডবসন রোডের রাঘব প্লাজা মল, অস্ট্রেলিয়ার ২৯ রেলডল্প স্ট্রিটে রয়েছে মিরোরা বাই ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের শোরুম।
দিলীপের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন মৃধার নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম অনুসন্ধান শুরু করে। টিমের অন্য দুই সদস্য ছিলেন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ খলিলুর রহমান সিকদার ও উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সাইদুজ জামান। অভিযোগটি দুদক বিধিমালা ২০০৭ মোতাবেক অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। দুদক থেকে সম্পদ বিবরণীর নোটিস পাঠানোসহ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দফা চিঠি দেওয়া হয় দিলীপ কুমারকে। অনুসন্ধান দলের এক সদস্য জানান, দিলীপের বিরুদ্ধে সোনা, হীরা চোরাচালানসহ বিদেশে অর্থ পাচারের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। এসব তথ্য-উপাত্ত যাচাইবাছাই করে যথাযথ প্রমাণ হাতে নিয়েই ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর নথিপত্রসহ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। কিন্তু নথিপত্রসহ দুদকে হাজির হতে দুই মাসের সময় চান দিলীপ। তবে পরবর্তী সময়ে পুনরায় চিঠি দিয়ে দুবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দিলীপ কুমার আগরওয়ালার সম্পদের তথ্য বিবরণী আর দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। দিলীপ কুমারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে দুদকের টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা বিভাগ, বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ডাক সঞ্চয় অধিদপ্তর, ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে চিঠি দেয়। শুধু দিলীপই নন, চুয়াডাঙ্গার আগরওয়ালা সম্প্রদায়ের প্রায় সবারই কলকাতায় ‘গদিঘর’ নামে ব্যবসায়িক ঠিকানা পাওয়া যায়। বংশানুক্রমেই তাঁদের সীমান্তের ওপারে যাতায়াত আর নানা পণ্য সরবরাহ ও বেচাকেনায় সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর যাচাইবাছাই শেষে মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু তিনি তদন্ত প্রভাবিত করে সময় ক্ষেপণ করান। প্রায় তিন বছর ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর দুদক হঠাৎই অভিযোগ নথিভুক্ত (দায়মুক্তি) করে। দায়মুক্তির ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দুদকের ওই সময়কার মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাইদ মাহবুব খান। দিলীপের দায়মুক্তির নথি নম্বর ০০.০১.০০০০.৫০২.০১.১৭২.১৭। দিলীপকে দায়মুক্তি দেওয়ায় প্রশ্ন ওঠে দুদকের কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে। এ ছাড়া ইকবাল মাহমুদ অবসরে যাওয়ার আগে যেসব দায়মুক্তি দেন সেগুলো নিয়েও নানা প্রশ্ন ওঠে।