Sat. Jun 21st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

anis-writerআনিসুল হক : খোলা বাজার২৪, শনিবার, ৫ মার্চ ২০১৬ : আমার একটা স্লোগান আছে। হারি-জিতি বাংলাদেশ! আমরা সব সময়ই বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ছিলাম, আছি আর থাকব। আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যকারেরা বারবার করে বলেছেন এই দেশের ক্রিকেটভক্ত দর্শকদের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা। এরা হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ। সেই যে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে আমরা রেডিও হাতে ছুটে গিয়েছিলাম রাস্তায়, তারপর থেকে তো সুখে-দুঃখে আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গেই আছি।
বিশ্বকাপে প্রথমবার গিয়েই আকরাম খানেরা হারিয়েছিলেন পাকিস্তানকে। তারপর কত কাঁটা বিছানো পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, কত তিমির গহন রাত্রি অতিক্রম করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্রিকেট দলকে সমর্থন দেওয়া এক দিনের জন্যও বন্ধ করেনি। আজ আমাদের প্রিয়তম দলটি আমাদের ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সমর্থনের বিনিময় দিতে শুরু করেছে। আমরা হোয়াইটওয়াশ করি জিম্বাবুয়েকে, নিউজিল্যান্ডকে, পাকিস্তানকে। আমরা সিরিজে হারাই দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতকে। একদিনের ক্রিকেটে জয়ের রেকর্ডে আমরা এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা দল। টি-টোয়েন্টিটা রপ্ত হয়ে উঠছিল না, অকুতোভয় বিশাল-হৃদয় অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে সেই দুর্বলতাও আমরা কাটিয়ে উঠছি! আর আমরা পেয়ে গেছি অনেকগুলো দ্রুতগতির বোলারকে! এই দেশ প্রতিভার খনি, কোন সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসে মুস্তাফিজ। একবার তো ভাষ্যকারেরা বলেছিলেন, এরা কী খায়, এই দেশে এত বাঁহাতি স্পিনার জন্মাচ্ছে কী করে! এখন তাঁদের গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতে হবে, এতগুলো পেসার এরা পেল কোথায়!
আজ বিজয়ের দিন! আজ কী যে ভালো লাগছে! যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে, পর হয়েছি আমি! না, আমি অবশ্য পর হইনি। মনে আছে, উপমহাদেশে বিশ্বকাপ হচ্ছে, শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ৫৮ করে অলআউট হয়ে গেল। আমরা, কয়েকজন ঘোষণা করলাম, দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু, কাজেই আমাদের যেতে হবে চট্টগ্রামে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার সময় মাঠে থাকতে হবে। রাতারাতি ট্রেনের টিকিট জোগাড় করে আমরা হাজির চট্টগ্রামে। সেই খেলায় আমরা জয়লাভ করেছিলাম। একে একে বাংলাদেশের উইকেট পড়ে যাচ্ছিল, শেষে তো বোলার শফিউল উদ্ধার করলেন। খেলা শেষ। বাংলাদেশ জিতে গেছে। দাঁড়িয়ে আছি একা, গ্যালারিতে। ইমরুল কায়েস পরে বলেছিলেন, আপনি যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি দেখেছি তো। তামিম ইকবাল কখনো চোখের দিকে তাকান না, কিন্তু তিনিও বলেছেন, আপনাকে সারাক্ষণই তো দেখি গ্যালারিতে। সাকিব আল হাসান তো একবার ধানমন্ডির মাঠে প্র্যাকটিস করছেন, তিনি তখন অধিনায়ক, আমি মাঠের গেটে দাঁড়িয়েছিলাম কৌতূহলবশত, পুরো মাঠ হেঁটে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্যার, আপনি!
মুশফিকের বাবা বগুড়ার তারা ভাইয়ের সঙ্গে তো বগুড়াতেও দেখা করি, মাঠে এসে তিনি খোঁজ করেন, ভাই কোথায়! নাসির তো প্রায় ঘরের ছেলে, বিদেশে বসেও ঈদ মোবারক পাঠান। মাশরাফির সেন্স অব হিউমারের কোনো তুলনা হয় না। একবার মেরিল-প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে তাঁকে বললাম, আপনার বিপরীতে একজন তরুণী মডেল থাকবেন, তিনি বলবেন, আমাকে তোমার চরণে ঠাঁই দাও। আপনি জবাব দেবেন, তোমার স্থান তো চরণে নয়, হৃদয়ে। আমরা জানি, ক্রিকেটাররা লজ্জা পাবেন, তাতেই আমরা হেসে কুটিকুটি হব। মাশরাফি আমাকে বলেন, আনিস ভাই, আমি ডায়ালগ বানিয়ে দিতে পারি? নিশ্চয়ই। মঞ্চে স্বর্ণা নামের মডেলটি মাশরাফিকে বললেন, আমাকে তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। মাশরাফি বললেন, আমার হাঁটুতে ছয়বার অপারেশন হয়েছে, সম্ভব না। আমরা সেদিন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু আমাদের চোখের কোণে অশ্র“ও খেলা করেছিল। কতবার অপারেশন টেবিলে সার্জনের ছুরির নিচে ফালা ফালা হয়েছে মাশরাফির হাঁটু। সেখান থেকে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন, দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সব ছেলেকে বুকে আগলে রাখছেন, আর তাঁর কলিজাটা কত বড়। পাকিস্তানের সঙ্গে ২ মার্চ ২০১৬-এর খেলায় তিনি ওপেনার ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ মিঠুনকে না পাঠিয়ে নিজেই নেমে গেলেন সাকিবের আউটের পরে, পরপর দুটো বল সীমানা পার করালেন, সেই সঙ্গে সীমানা পার করালেন সমস্ত সংশয়, আবারও জানিয়ে দিলেন, এই বাংলাদেশ নতুন বাংলাদেশ!
ওই সময় খেলাটা কি শ্বাসরোধী আর স্নায়ুধ্বংসীই না হয়ে উঠেছিল। ১৮ বলে ২৬। সাকিব আউট! বুকের ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। আমার আব্বার শেখানো একটা দোয়া আছে, আমি সেটা পড়ছি বারবার। মাশরাফির দুটো চার চাপ অনেকটা কমাল। চাপ তো কেবল আমাদের ওপর নয়, পাকিস্তানিদের ওপরেও। দুটো নো-বল দিলেন সামি। তারপর রিয়াদের বাউন্ডারিতে সোজা ফাইনালে। ওই সময় মাঠে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুচোখ বেয়ে অশ্র“ গড়াতে লাগল। আবেগের অশ্র“, আনন্দের অশ্র“। বাংলাদেশের মানুষ—পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না, আনন্দে চোখ মুছেছেন। আমি যথারীতি গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলাম। খেলেছে ১১ জন, কিন্তু আমরা ১৬ কোটি মানুষই যে এই বিজয়ের গৌরবের সমান অংশীদার। কি ধনী, কি গরিব, কি শহরবাসী, কি পাড়াগাঁবাসী, কি পাহাড়ের, কি সমতলের।
একটা তুলনা আমি কখনো করি না। ক্রিকেটের বিজয়কে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করি না। ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না, কথাটার মধ্যে একটা মৌলিক ভ্রািন্ত আছে, পতাকা, দেশ, রাষ্ট্র—এগুলো রাজনৈতিক ধারণা, আমি যে বাংলাদেশকে সমর্থন করি, তা বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলে বলে নয়, বাংলাদেশ আমার দেশ বলে। কাজেই ক্রিকেটে অবশ্যই রাজনীতি আছে। কিন্তু ক্রিকেট মাঠের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জয়-পরাজয়ের কোনো তুলনা চলতেই পারে না। কারণ, ক্রিকেট একটা খেলা মাত্র, আমরা জিততেও পারি, হারতেও পারি, ড্রও হতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পরাজয় নেই। মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি, পাকিস্তানের জেনারেলরা রেসকোর্স ময়দানে হাতের অস্ত্র মাটিতে ফেলে কোমরের বেল্ট খুলে ফেলে, শার্ট প্যান্টের বাইরে বের করে মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করেছেন, এটা আর কোনো দিনও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না।
ক্রিকেট মাঠে হারলেও স্বাধীনতাসংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে আমরা জিতেছি। আর সেই স্বাধীনতা, সেই জয় আমাদের দিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার বীজমন্ত্র। জাতি হিসেবেও আমরা এগিয়ে চলেছি। বহু ক্ষেত্রে আমরা ভালো করছি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি আজ বিশ্বের বিস্ময়। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে, পাকিস্তানে টিকাদানকারীদের ওপর হামলা হয়েছে। নারীশিক্ষায় বাংলাদেশ ভালো করছে, এমনকি ছেলেদের চেয়েও, পাকিস্তানে মালালার মাথায় গুলি করা হয়েছে। আর স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারের বেলায় আমরা ভালো করছি ভারতের চেয়েও।
ক্রিকেটের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জয়-পরাজয়কে মেলাব না। কিন্তু ২ মার্চ যে জাতীয় পতাকা দিবস, ওই দিন ১৯৭১ সালে ছাত্ররা যে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল, সবুজ ও হলুদ পতাকা উত্তোলন করেছিল, তারপর ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার হাতে পতাকা তুলে দিয়ে এসেছিল, এটাও ভোলা যায় না। সম্প্রতি জেনারেল ও নারীরা উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে ইতিহাসের এই সব অধ্যায়ের ভেতরেই আমাকে থাকতে হয়েছে। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ফেব্র“য়ারিতেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, দরকার হলে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসটা পুরোপুরি খুব সংক্ষেপে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা আছে। ‘আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ কথাটা তিনি এমনি এমনি বলেননি। বারবার করে বলেছেন, বাঙালিরা বুঝেসুজে কাজ করবেন। বলেছেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কথা, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার কথা। এই লেখাটা লিখছি ৩ মার্চ ২০১৬। ৪৫ বছর আগে এই দিনে মালিবাগে মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পাকিস্তানি সৈনিকদের গুলিতে শহীদ হন আবুজর গিফারী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফারুক ইকবাল। বুলেটবিদ্ধ ফারুক ইকবাল মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, পানি পানি বলে অস্ফুট আওয়াজ করছেন। কিংবদন্তি হলো, পানি নিয়ে এসে জনতা দেখল, ফারুক ইকবাল তর্জনীতে নিজের রক্ত ভিজিয়ে রাজপথে লিখছেন—জয় বাংলা।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভীষণ পছন্দ করতেন পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়াকে। আর খুবই অপছন্দ করতেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। নিক্সন তাঁর সামরিক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে কী কী কথা বলতেন, সেসবের অনেক কিছুই এখন আমেরিকান সরকার প্রকাশ করে দিয়েছে। তাতে একটা পর্যায়ে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যখন ভারত যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিচ্ছে, মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনী দ্রুত হটিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনীকে, তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বললেন, চীনকে বলো, ভারত আক্রমণ করতে। কিসিঞ্জার বললেন, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন আক্রমণ করবে। আর তাহলে আমাদের সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে হবে।
নিক্সন বললেন, করব।
‘তাহলে আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।’
নিক্সন তাতেও রাজি।
একটা আণবিক যুদ্ধের দরজায় দাঁড়াল বিশ্ব। নিউইয়র্কে চীনের জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে বলা হলো, ভারত সীমান্তে সৈন্য পাঠাতে। এক দিন পরে চীন জানিয়ে দিল, তারা ভারত আক্রমণ করবে না। লাখ লাখ রুশ সৈন্য চীনে ঢুকে পড়ছে, এটা তারা কল্পনাও করতে পারছে না!
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে চীনের, যুক্তরাষ্ট্রের বাধাকে অতিক্রম করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় শূন্য হাতে, শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে। ওই স্বপ্নের পরশমণি আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবির কথাই ঠিক, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। আমাদের দেশটা স্বপ্ন দিয়ে তৈরি, আমাদের দেশটা স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। স্মৃতি ও স্বপ্নের ভিত্তিভূমিতে আমরা এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছি বাস্তবিক বিজয় নিয়ে। এমন দিনে প্রাণভরে গাওয়া যায়—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি যে আমার জন্মভূমি। এমন দিনে চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে বলা যায়—ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।
জাতিকে এমন সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য মাশরাফির দলকে হৃদয়-নিংড়ানো অভিনন্দন। প্রথম আলো
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।