Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
খোলা বাজার২৪ শনিবার, ৬ আগস্ট ২০১৬ :তানভীর হাসান সিরাজগঞ্জে গ্রেপ্তার চার নারী _ফাইল ছবিস্বামীসহ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্ররোচনায় নারীরাও সর্বনাশা জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো হামলায় অংশ না নিলেও শিগগিরই তারাও এতে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ায় পুরুষ জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় নারী সদস্যদের হামলার মিশনের অগ্রভাগে নিয়ে আসার ছক অাঁটার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
প্রসঙ্গত, নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে সম্প্রতি সিরাজগঞ্জে জেএমবির চার নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার হয় সংগঠনটির আত্মঘাতী দলের তিন নারী সদস্য। ধারণা করা হচ্ছে, দেশে নারী জঙ্গি সদস্যের সংখ্যাও কম নয়।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ উমর ফারুক নিজের গবেষণার বরাত দিয়ে জানান, জঙ্গিরা নিজেদের অপরাধের ঢাল হিসেবে নারীদের ব্যবহার করে। সমাজে নারীদের প্রতি নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সাধারণত তারা কোনো অপরাধে জড়ান না বলেই ধারণা করা হয়। এ কারণে তাদের ব্যবহার করে নিজেদের কাজ সহজ করে নেয় জঙ্গিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেএমবির পুরুষ সদস্যরা স্ত্রী-বোন-শ্যালিকাকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা ছাড়াও একে অন্যের নারী আত্মীয়কে বিয়ে করেন। এতে নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরির পাশাপাশি কাছাকাছি মানসিকতার একজনকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়। এতে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতেও বেগ পেতে হয় না।
সম্প্রতি রাজধানীর রামপুরার চিকিৎসক রোকন উদ্দিন পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে ‘নিখোঁজ’ হন। তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমে নিজে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়ান এবং পরে স্ত্রী-সন্তানদেরও সেই পথে টেনে নেন। চিকিৎসক ওই পরিবারের মতো এখন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ পড়ুয়া অনেক তরুণীও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। অন্তত চার তরুণী আইএসে যোগ দিতে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
তদন্ত ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জে গ্রেপ্তার চার নারীর মধ্যে রুমা খাতুনের স্বামী মামরুল ইসলাম সরদারের মূল নাম মামুনুর রশীদ মামুন। তিনি পঞ্চগড়ের পুরোহিত হত্যা ও রংপুরে বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা হত্যাচেষ্টায় অন্যতম সন্দেহভাজন। পুরোহিত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শফিকুল ইসলাম জবানবন্দিতে মামুনের নাম বলেছিলেন। জেএমবি সদস্য মামুন তার স্ত্রীকে একই সংগঠনে নিয়ে এসেছেন। পলাতক মামুনের পরিবারের সদস্যরা জামায়াত ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নাদিয়া তাবাসসুম রানীর স্বামী মাহবুবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি গোবিন্দগঞ্জের গুমানিগঞ্জ ইউনিয়নের পার্বতীপুরে। তিনি ১১ বছর আগে বাড়ি ছাড়েন। তিনি জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত। পরে তার মাধ্যমেই রানীও উদ্বুদ্ধ হন বলে জানা গেছে।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ওই নারীরা দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। তাদের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানা গেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যাবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সম্প্রতি ইডেন কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এ ইঞ্জিনিয়ারের বিয়ে হয়। বিয়ের পরই বদলে যেতে থাকেন ওই কলেজ ছাত্রী। বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। একসময় স্বামী স্ত্রী দু’জন আমেরিকায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কবে কোন ফ্লাইটে তারা আমেরিকায় গিয়েছেন সেই তথ্যও জানতে পারেনি ওই দম্পতির পরিবারের সদস্যরা। গুলশান হামলার পর ওই নারীর বাবা রাজধানীর কলাবাগান থানায় এ ব্যাপারে একটি জিডি করেন। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করতে রাজি হয়নি সংশ্লিষ্টরা।
তবে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, মূলত জঙ্গি কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই বাড়ি ছেড়েছেন। উগ্রপন্থীদের ভাষায় এই বাড়ি ছাড়ার বিষয়টি কথিত ‘জিহাদ’-এর অংশ। তারা ধরেই নিয়েছেন এই পথে তাদের মৃত্যু হতে পারে। স্বামীর মৃত্যুর পর ওই নারীকে কে বিয়ে করবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করা। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে হামলা করতে গিয়ে কিংবা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গিদের কেউ নিহত হলে তার স্ত্রীকে কে বিয়ে করবে, সেটাও আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তা জানান, নিষিদ্ধ সংগঠনের এসব সদস্য কৌশলে নারীদের ঘরছাড়া করে। তাদের ভাষায় একে বলে ‘হিযরত’। এই কথিত হিযরত করা নারীর জঙ্গি নেটওয়ার্কের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তারা জঙ্গি কর্মকা-ের অনেক খবর রাখে। আর এ কারণেই স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের নিজেদের (জঙ্গি) নেটওয়ার্কের বাইরে যেতে দেয়া হয় না। এটি নিশ্চিত করতেই কোনো নারী জঙ্গির স্বামী (জঙ্গি) পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কিংবা নিহত হলে তার দায়িত্ব কে নেবে সেটা আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে ওই নারীর দ্বিতীয় স্বামী মারা গেলে আবার তৃতীয় জনের (জঙ্গি) কাছে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রেও ওই জঙ্গি নারীর দ্বিতীয় স্বামী বিয়ের পরপরই নির্ধারণ করে রাখে- মৃত্যুর পর কার সঙ্গে তার স্ত্রীর বিয়ে হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই নারী চাইলেও অন্যত্র বিয়ে করতে পারে না। সে অন্যত্র বিয়ে করলে তাদের নেটওয়ার্কের অনেক খবর বাইরে ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থেকেই তারা এমনটি করে থাকে। এ ধরনের একাধিক নারীর তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টোরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা। তাদের গ্রেপ্তার করতে বিভিন্নস্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ৪ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার যোকারচর রেলগেটের পাশের একটি বাড়ি থেকে জেএমবির তিন নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন- রোজিনা বেগম, সাজিদা আক্তার ও জান্নাতী ওরফে জেমী। পুলিশের কাছে তারা জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্ররোচনায় তারা উগ্রপন্থায় জড়ান। এর আগে ৭ মে বগুড়া থেকে মাছুমা খাতুন নামে এক নারী জেএমবির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি গত ৩ এপ্রিল শেরপুরে গাড়ীদহে গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত জেএমবি সামরিক শাখার প্রধান রাইসুল ইসলাম খান ফারদীনের স্ত্রী। মাছুমার ভাই জেএমবির সক্রিয় সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে বোমা শাকিলের বোন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান বিস্ফোরণের পর ২০১৪ সালের নভেম্বরে সেখানে ধরা পড়েন জেএমবি সদস্য সুজেনা বেগম। স্বামী শাহিনুর আলমের মাধ্যমে তিনি জঙ্গিবাদে জড়ান।
জানতে চাইলে, টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান জানান, বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এতে জানা গেছে, কোনো জঙ্গির মৃত্যু হলে, তার স্ত্রীকে কে বিয়ে করবে বা তার দেখাশোনা কে করবে সেটা আগে থেকেই সিস্টেম করা থাকে। বর্তমানে যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রেও এমন পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে।