খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭: চীন তার ভূ-রাজনৈতিক কক্ষপথে ক্রমাগত বেশি করে মিয়ানমারকে টেনে নিচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। এমনকি কোনো কোনো দেশ ‘জাতিগত নির্মূল’ এবং ‘গণহত্যার’ জন্য মিয়ানমারের নেতাদের বিচার করার আহ্বান পর্যন্ত জানাচ্ছে। আক্রান্ত প্রতিবেশী দেশটির কাছ থেকে সুবিধাজনক ছাড় আদায় করার জন্য একে সুবর্ণ সুযোগ মনে করছে বেইজিং।
এই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে চীন কেবল দেশটির বেসামরিক ও সামরিক নেতাদের সাথেই সম্পর্ক জোরদার করছে না, বরং সমন্বিত উপায়ে দেশটির সমন্বয় প্রক্রিয়া এবং এর রাজনৈতিক দৃশ্যপট বিনির্মানেও কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, শান্তি-প্রক্রিয়াকে সমর্থন করা এবং বিদ্রোহী কিছু জাতিগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ছাতার নিচে নিয়ে আসা, বেসামরিক সরকার এবং দেশটির সামরিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করা।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অর্থনৈতিক করিডোরের পরিকল্পনা ঘোষণা করার সাথে সাথেই মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী ড. থান মিয়ন্ত সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, দেশের কাছে আর ‘কোনো বিকল্প না থাকায়’ মিয়ানমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এসব উদ্যোগ থেকে বেইজিং বিপুলভাবে লাভবান হচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতি চীনের দৃঢ় সমর্থনের পেছনে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। চীনা কূটনীতিকরা সাউথ এশিয়ান মনিটরকে সম্প্রতি বলেছেন, ‘চীনের কাছে মিয়ানমার এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের অংশ হিসেবে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন উভয় দিক থেকেই এটি চীনের জাতীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের কৌশলগত পরিকল্পনায় চীনের পশ্চিমে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে এবং দক্ষিণে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাকি অংশকে সংযুক্তকারী চীনের পরিবহন ও অর্থনৈতিক সংযোগে মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কিছু সময় ধরেই এ কাজ চলছিল। তবে গত মাসে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ান ইয়ি মিয়ানমার সফরের সময় মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক করিডোরের যে ঘোষণা দেন তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই করিডোরের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে মান্দালয়, সেখান থেকে ইয়াঙ্গুন, পশ্চিমে কিয়াকফু এবং পূর্বে মায়াদ্দি যাবে। এটি থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামকে সংযুক্ত করবে। স্থানগুলো সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। এসব সড়কের কোনো কোনো অংশ ইতোমধ্যেই নির্মিত কিংবা উন্নত করা হয়েছে। কিয়াকফুতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করা হবে। এটা পাশ্চাত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচল লেনের ব্যবস্থা করবে। ভারত মহাসাগরে যাওয়ার উপযোগী এই লেন দিয়ে মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে পণ্য আমদানি করা হবে।
এসব প্রকল্প চীনের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপুল লাভজনক হলেও মিয়ানমারের জন্যও অনেক সুবিধার সৃষ্টি করছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনৈতিক ঝটিকা সফরের সময় যে অর্থনৈতিক করিডোরের কথা ঘোষণা করেন, সেই একই পর্যায়ে তিনি সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তের পুনর্বাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতাও করেন।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অর্থনৈতিক করিডোরের পরিকল্পনা ঘোষণা করার সাথে সাথেই মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী ড. থান মিয়ন্ত সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, দেশের কাছে আর ‘কোনো বিকল্প না থাকায়’ মিয়ানমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, রোহিঙ্গা জনসাধারণের ওপর সহিংসতার কারণেও ক্রমবর্ধমান হারে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বিদেশীরা। ফলে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহায়তা, বিশেষ করে অবকাঠামো সম্প্রসারণের জন্য চীনের দিকে হাত বাড়ানো ছাড়া মিয়ানমারের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।
অবশ্য তিনি ইঙ্গিত দেন, এই বিকল্প একেবারে শর্তহীন নয়। চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছা হলো, এসব প্রকল্পে চীনা নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং চীনা শ্রমিকদের প্রায় পুরোপুরিই ব্যবহার করা হবে। হাজার হাজার চীনা শ্রমিক ইতোমধ্যেই মিয়ানমারে প্রবেশ করছে, তারা রাখাইন থেকে কুনমিং পর্যন্ত বিস্তৃত তেল পাইপলাইন এবং অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছে।
এসব প্রকল্প চীনের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপুল লাভজনক হলেও মিয়ানমারের জন্যও অনেক সুবিধার সৃষ্টি করছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনৈতিক ঝটিকা সফরের সময় যে অর্থনৈতিক করিডোরের কথা ঘোষণা করেন, সেই একই পর্যায়ে তিনি সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তের পুনর্বাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতাও করেন। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই যাতে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়, সেজন্যও চীনারা পর্দার অন্তরালে কাজ করছে বলে মিয়ানমার সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সরকারের শান্তি-প্রক্রিয়া সমর্থনকারী প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে চীন। এখনো জাতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে (এনসিএ) সই করেনি এমন কয়েকটি জাতিগত বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় রয়েছে চীন। এর মাধ্যমে তারা ফেডারেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টির রাজনৈতিক আলোচনাতেও অখ- অংশীদারে পরিণত হয়েছে। চীনা নেতৃবৃন্দ সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্ললাইন এবং বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চি উভয়কেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা শক্তিশালী কচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অর্গানাইজেশনসহ সাতটি জাতিগত গ্রুপ নিয়ে গঠিত উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় রাজি করাবে।
তারা এনসিএতে সই করে আগামী জানুয়ারির শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় তৃতীয় রাউন্ডের শান্তি সম্মেলন তথা পাংলংয়ে অংশ নেবে। ওই সভার প্রক্রিয়া এবং এজেন্ডা নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী সপ্তাহে বেশ কয়েকটি বৈঠক হবে। শান্তি-প্রক্রিয়ায় এই জোট বেশ বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এই জোট বলে আসছিল, তারা এনসিএতে সই করবে সম্মিলিতভাবে, আর মিয়ানমার সরকার তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে সই করতে বলছিল। অবশ্য সম্প্রতি মনে হচ্ছে, এই অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে। সরকারের এক সদস্য সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেছেন, চীন চাপ দিলে তাদের কাছে চুক্তিতে সই না করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
এতে চীনেরও স্বার্থ আছে। চীনা কূটনীতিকদের মতে, মিয়ানমার সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় বেইজিং। উত্তরাঞ্চীয় জোট যদি শান্তি-প্রক্রিয়ায় রাজি হয়ে অস্ত্র সমর্পণ করে, তবে পাইপলাইনসহ চীনা প্রকল্পগুলো নিরাপদ থাকবে। রাখাইনের অস্থিতিশীলতা এবং যুদ্ধও চীনা বন্দর নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে আরাকানের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধও চীনের কাছে কাম্য।
বেইজিং সফর-পরবর্তী তাদের এই বৈঠকটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক সূত্র জানিয়েছে, এই সভায় তারা সেনাবাহিনীতে উত্তরসূরি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামরিক বাহিনীর অনেকেই এখন বিশ্বাস করছেন, মিন অং হ্লাইঙ শিগগিরই সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন। এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে সু চির অনুমোদনের প্রয়োজন।
চীনের আরেকটি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র হলো রাজনৈতিকবিষয়ক। অং সান সু চি এবং সেনা কমান্ডারের মধ্যে মধ্যস্ততা করা। সু চি এবং হ্ললাইঙের সাথে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, কয়েক মাস ধরে এই দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। একে অপরকে অবিশ্বাস করে, অথচ উভয়েই জানে, তাদের একজনকে আরেকজনের প্রয়োজন এবং তাদেরকে একসাথেই কাজ করতে হবে। তাদের দুজনই সম্প্রতি আলাদা আলাদাভাবে বেইজিং সফর করেছেন এবং তাদের মেজবান চীনারা মধ্যস্ততাকারী হিসেবে কাজ করার বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। চীন সফর থেকে এসে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে সহিংসতার পর তারা মাত্র একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, অক্টোবরের শেষ দিকে তারা শান্তি-প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বেইজিং সফর-পরবর্তী তাদের এই বৈঠকটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক সূত্র জানিয়েছে, এই সভায় তারা সেনাবাহিনীতে উত্তরসূরি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামরিক বাহিনীর অনেকেই এখন বিশ্বাস করছেন, মিন অং হ্লাইঙ শিগগিরই সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন। এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে সু চির অনুমোদনের প্রয়োজন। ৬০ বছর হওয়ায় সেনাবাহিনী কমান্ডারের অবসর গ্রহণের কথা ছিল ২০১৬ সালের প্রথম দিকে। ওই বয়সেই সামরিক অফিসারদের অবসর গ্রহণের বাধ্যতামূলক সময়। কিন্তু সু চি দুই বছর তার মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তা না মেনে পাঁচ বছর তথা ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ায়। এর পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে এটিই বিরোধের প্রধান ইস্যু হয়ে আছে।
এখানেও বেইজিং শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে কাজ করছে। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে চীন ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। চীন রাজনৈতিক বিভেদ তো চায়ই না, রাজনৈতিক উত্তেজনাও তাদের কাম্য নয়। বিভেদ দেখা দিলে বিঘœতার সৃষ্টি হয়ে অভ্যুত্থানও ঘটতে পারে। উভয় পক্ষের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় চীন মধ্যস্ততাকারী হিসেবে ভালো অবস্থানে আছে। তারা সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি রেখে চুক্তি করতে চায় না।
মিন অং হ্লাইঙ মনে করতে পারেন, চীন পাশে থাকলে যেকোনো জাতিসংঘ অবরোধ এবং তাকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে নেওয়ার প্রস্তাব জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ঠেকাতে পারবে চীন। চীন অন্তত ভোট দানে বিরত থাকবে। আর সু চির কাছে অর্থনৈতিক সুবিধা এবং শান্তি-প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারাটা একটি আকর্ষণীয় বিষয়।