
খোলাবাজার অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাত এক সময় মূলধন বাজারে স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। ফান্ডগুলো সবসময় ফান্ডামেন্টাল শেয়ার ক্রয় করে বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত ডিভিডেন্ড প্রদান করত। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর নীতি ও পদক্ষেপের কারণে এ খাত আজ গভীর সংকটে নিমজ্জিত।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মূলধনভিত্তিক ভালো শেয়ারের পরিবর্তে জাংক শেয়ারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তার সময়েই রিং শাইন, ফরচুন সুজ, সোনালী পেপারের মতো দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারগুলো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়। পাশাপাশি ‘ফ্লোর প্রাইস’ নীতি চালু করে বাজারে কৃত্রিম অচলাবস্থা তৈরি করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাব আজও অব্যাহত।
বর্তমান কমিশনের কঠোর প্রভিশনিং রুল ও ফ্লোর প্রাইসের প্রভাবে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর পোর্টফোলিওতে থাকা মানসম্মত শেয়ারের মূল্য ব্যাপকভাবে কমে গেছে, ফলে অধিকাংশ ফান্ডই বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না। এসেট ম্যানেজারদের মতে, এই নীতি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বড় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে রেখেছে। যদি বর্তমান অবস্থায় রিডেম্পশন বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে ফান্ডগুলোর নেট অ্যাসেট ভ্যালু (NAV) ব্যাপকভাবে কমে যাবে এবং রিডেম্পশন ট্যাক্স ও খরচ বাদে বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত মূলধনের অল্প অংশই ফেরত পাবেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্রোকারেজ হাউস, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও সামগ্রিক বাজার।
অন্যদিকে, কিছু কোম্পানি কম মূল্যে মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট কিনে রেখেছে এবং তারা রিডেম্পশন বাস্তবায়নে উৎসাহী, কারণ এতে তারা লাভবান হবে, কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
গত ১৫ বছরে মেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ডগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার বেশি ডিভিডেন্ড প্রদান করেছে। এসব ফান্ড বন্ধ হয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে এই স্থিতিশীল আয়ের উৎস সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে।
অ্যাসেট ম্যানেজারদের অভিযোগ, মাত্র দুইটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের দায়ে ৬৯টি অ্যাসেট ম্যানেজারের পুরো শিল্পকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ২৫০ কোটি টাকার অভিযোগের জন্য ২০,০০০ কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। অথচ অতীতে ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও, সেক্টরব্যাপী এমন দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তারা আশঙ্কা করছেন, কমিশন ও এসেট ম্যানেজারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়লে বিনিয়োগকারীরাই চূড়ান্ত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এর আগেও একই ধরনের দ্বন্দ্বে, এআইএমএস কর্তৃক দায়ের করা মামলার কারণে মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারীরা ৫-৬ বছর লভ্যাংশবিহীন অবস্থায় ছিলেন, যা পুরো সেক্টরকে স্থবির করে দেয়।
এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। অথচ ট্রাস্টি ও কাস্টোডিয়ানরা বিএসইসিকে লিখিতভাবে জানিয়েছে যে ফান্ডগুলোর সম্পদ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
মিউচুয়াল ফাণ্ড এর বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, যেভাবে বিএসইসি তাড়াহুড়ো করে “বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০২৫” বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, তা গভীর উদ্বেগজনক। তারা বলেছে, “এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি নীতি প্রণয়ন করা উচিত, যা এই খাতের উন্নয়ন ও মূলধন বাজারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।”
পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার অন্যতম স্তম্ভ মিউচুয়াল ফান্ড শিল্প বর্তমানে নীতিনির্ধারকদের অব্যবস্থাপনা, পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত ও অকার্যকর বিধিবিধানের কারণে ধ্বংসের মুখে পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কমিশনের উচিত তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত পরিহার করে আলোচনাভিত্তিক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা।


