খোলা বাজার২৪, রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০১৬: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থামছেই না মৃত্যুর মিছিল। একযুগে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির চারজন শিক্ষক নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন।
সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হন্তারকদের বিচারের আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন। এর ফলে হত্যাকারীরা সক্রিয় রয়েছে। নিয়মিত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হুমকির শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা। এসব ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ না নিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকে পুলিশ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। এ পর্যন্ত মাত্র দুজন শিক্ষক হত্যার ঘটনায় বিচার হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বহুল আলোচিত এই দুই হত্যাকা-ের হোতাদের সন্তোষজনক শাস্তি হয়নি।
লাশের মিছিলে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও একটি নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হয়েছেন। গত ২৩ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ৭টায় নগরীর শালবাগান এলাকায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এর আগে ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে প্রাতঃভ্রমণে বের হলে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুরের নিজ বাসভবনের সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইউনুস। এ ঘটনায় তার ছোট ভাই আব্দুল হালিম বাদী হয়ে ওই দিন নগরীর মতিহার থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। সিআইডি পুলিশ মামলার তদন্ত শেষে ৮ জেএমবি সদস্যকে আসামি করে এ মামলার চার্জশিট দেয়। পরে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ছয়জনকে বেকসুর খালাস দিয়ে দুই আসামির মৃত্যুদ-াদেশ দেয় রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল।
প্রথম হত্যকা-ের একবছর পার হতেই ২০০৬ সালের ১ ফেব্র“য়ারি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। পরে দুদিন পর ৩ ফেব্র“য়ারি বাসার পেছনের সেপটিক ট্যাংক থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এই হত্যাকা-ে জড়িত থাকার দায়ে আদালত বিভাগের এক শিক্ষক, এক শিবির নেতাসহ চারজনকে মৃত্যুদ- দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। পরে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল দুজনের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন হাইকোর্ট। আর বাকি দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়। মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলেন ড. তাহেরের সহকর্মী একই বিভাগের শিক্ষক ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন এবং ড. তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
এরপরে গত ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক লালনভক্ত অধ্যাপক শফিউল ইসলাম। তিনি মুক্তমনা ও প্রগতিশীল আদর্শের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলেন। এ হত্যার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুক পেজে হত্যার দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেয় জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ।
পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এন্তাজুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মতিহার থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। ২৩ নভেম্বর এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যুবদল নেতা আব্দুস সামাদ পিন্টুসহ ৬ জনকে আটক করে র্যাব। পরে পিন্টুর স্ত্রী নাসরিন আখতার রেশমাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে রেশমা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এ হত্যা মামলার কয়েক বার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলের পর গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রেজাউস সাদিক চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ১১ জনের নাম উল্লেখ ছিল।
ওই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
এখানেই শেষ নয়, সর্বশেষ শনিবার সকালে নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হলেন আরেক শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ এগোতেই গলির মধ্যে পেছন থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম বলেন, উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী কৌশলে প্রগতিশীল শিক্ষকদের হত্যা করছে। কিন্তু পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের আটক করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু শিক্ষক নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে যেকোনো মানুষ হত্যার দায় পুলিশ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। বাসার সােেমন একজন শিক্ষককে হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা।
সবসময় ভীতির থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাকেসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে মোবাইল ফোন ও চিঠির মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমাকে যখন হুমকি দেওয়া হয়েছিল তার একদিন পর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু থানা থেকে এ বিষয়ে জিডি করাকে খুবই হালকা করে দেখা হয়।
তিনি বলেন, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক স্যারের মতো ব্যক্তিকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একজন সাব-ইন্সপেক্টর ছাড়া পুলিশের কোনো সদস্য এ ব্যাপারে খোঁজ নেননি। পুলিশের এমন নির্লিপ্ততার কারণেই সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে। পুলিশ যদি এসব হুমকির ব্যাপারে তদন্ত করে একজনকে গ্রেফতার করত তাহলে সন্ত্রাসীরা কিছুটা হলেও ভীত থাকত। এসব হত্যাকা-ের জন্য তিনি পুলিশকেই দায়ী করেন।
এসব ব্যাপারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সবসময় চায় হত্যাকা-ের শিকার শিক্ষকদের বিচার হোক। এর সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ বিচার এবং শাস্তি আমাদের কাম্য। কিন্তু আইনগত কৌশলের কারণে এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার আন্তরিকতার অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার মো. শামসুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা যেকোনো হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে বদ্ধপরিকর। পুলিশ এ ব্যাপারে সবসময় আন্তরিক। অপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতরা অত্যন্ত কৌশলী। তাদের রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক।
এ কারণে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা গেলেও গ্রেপ্তারে বিলম্ব ঘটে। তবে আমরা অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের আটকের জন্য অভিযান চালাচ্ছি। একজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটকও করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও দ্রুত আটক করার জন্য অভিযান চলছে।