ড. হারুন রশীদ।। খোলা বাজার২৪, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৬: ঋতুর পালাবদলের পরিক্রমায় প্রকৃতিতে এখন শীতের আগমনী ধ্বনি। কবির ভাষায়, ‘শীতের হাওয়ায় লাগল কাঁপন আমলকীর ওই ডালে ডালে।’ ষড়ঋতুর এ দেশে একেকটি ঋতু একেক রূপ, রং ও রস নিয়ে উপস্থিত হয়। মানুষজনকে প্রকৃতির এই পালাবদলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়।
শীত এলে অনিবার্যভাবেই প্রকৃতিতে ঘটে কিছু পরিবর্তন। হেমন্তের ফসল কাটা শেষ হয়। কাটা শস্যের নাড়াপুচ্ছে জমতে থাকে শিশির। নবান্নের সঙ্গে পিঠা-পায়েসের আয়োজন চলে গ্রামাঞ্চলে। এই নগরেও এখন মৌসুমি পিঠা বিক্রেতারা তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। শীত একদিকে যেমন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে, অন্যদিকে তীব্র শীত জীবনযাত্রা বিপন্ন করে তোলে মানুষজনের। বিশেষ করে শিশুদের জন্য শীতকাল নানা দুর্ভোগ নিয়ে আসে। শিশুদের এই সময়ে শীতজনিত নানা রোগব্যাধিও দেখা দেয়। দরিদ্ররা শীতের কাপড়ের অভাবে কষ্ট পায়। এ জন্য শীতের ব্যাপারে আলাদা একটি প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন।
শীত মৌসুমে শিশুদের ঠাণ্ডাজনিত নানা রকম রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডায়রিয়া, জ্বর, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় শিশুরা। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এরই মধ্যে জেঁকে বসেছে শীত। কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক। কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা কমে আসে। দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলও বিঘিœত হয়। এ জন্য সতর্কবার্তা জারি করা উচিত। এ সময় শৈত্যপ্রবাহেরও আশঙ্কা থাকে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ঋতুর পরিবর্তন হবে—এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য প্রতিটি ঋতুই যেন উপভোগ করা যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। শীতজনিত রোগব্যাধি থেকে মানুষজনকে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখতে হবে। তীব্র শীতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সে জন্য গরম কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সরকার নয়, সমাজের বিত্তবানরা এ জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। কবি সুকান্ত যেমন করে সূর্যের কাছে উত্তাপ চেয়েছিলেন ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটির জন্য’, তেমনিভাবে আমাদের মধ্যে এই শীতে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। আর তখনই শীত কষ্টের ঋতু না হয়ে উৎসবের ঋতু হয়ে উঠবে।
দুই.
শীতকালে এমনিতেই শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগব্যাধি বেড়ে যায়। তার ওপর ধুলার রাজত্বে অসহায় হয়ে পড়েছে রাজধানীবাসী। ধুলার কারণে একদিকে বাড়ছে জনভোগান্তি, অন্যদিকে রোগবালাই। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশুদের ধুলার জন্য নানা অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। বলতে গেলে বছর ধরেই ধুলার রাজত্ব চলে রাজধানীতে। এ নিয়ে নগরবাসীর দুর্ভোগের কোনো অন্ত না থাকলেও সমস্যা সমাধানের যেন কেউ নেই। কিন্তু এ অবস্থা দিনের পর দিন চলতে পারে না। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রাজধানীকে ধুলামুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকাজ, রাস্তা সংস্কার কিংবা উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে উন্মুক্তভাবে। নিয়মানুযায়ী নির্মাণ এলাকা ঘেরাও করে কাজ করার কথা থাকলেও তা না করে মাটি, বালু, পাথর ইত্যাদি রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। গাড়ির চাকায় সেগুলো পিষ্ট হয়ে ধুলা ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। মাটি ও বালুবোঝাই ট্রাক রাজধানীতে প্রবেশ করছে উন্মুক্তভাবে। ধুলা সৃষ্টি হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বিশৃঙ্খলার কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
ধুলা ছড়িয়ে পড়ছে বাসাবাড়িতেও। প্রতিদিনই দেখা যায় আসবাবের ওপর ধুলার পুরু আস্তরণ পড়েছে। জামাকাপড় ও ঘরদোর পরিষ্কার রাখতে গিয়েই গলদঘর্ম হতে হয়। লোকজনকে নাকে রুমাল দিয়ে রাস্তায় চলতে হচ্ছে এখন।
রাজধানীতে উন্নয়নকাজে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। ওয়াসা, ডেসা, তিতাস—এক সংস্থা তাদের কাজ শেষ করে তো আরেক সংস্থা শুরু করে। এ কারণে সারা বছরই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলতে থাকে। ফলে উৎপাদন হয় ধুলা। একদিকে অপচয়, অন্যদিকে ধুলা সৃষ্টি। এ অবস্থায় ধুলা নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, ধুলার অত্যাচারে রাজধানীবাসী অতিষ্ঠ। এ থেকে তাদের রক্ষা করতে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে দুই সিটি করপোরেশনকে।
তিন.
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ‘ইউনিসেফে’র এক প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে আট হাজার ৫০০ শিশুর মৃত্যু হয় বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মৃত্যু রোধ ও শিশুর সার্বিক নিরাপত্তায় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন শিশু অর্থাৎ প্রতি সাতজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু বাড়ির আঙিনায় দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে। ‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার অব চিলড্রেন’—এই কার্যক্রমে ব্যবহৃত উপগ্রহ চিত্রে প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে যে বাড়ির আঙিনায় বহু শিশু বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে। মরক্কোর মারাকেশে কপ-২২-এর সম্মেলন শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরই ইউনিসেফ এই চিত্র প্রকাশ করল। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুরাই এ ধরনের দূষিত বায়ুর মধ্যে বেশি বসবাস করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ৬২০ মিলিয়ন শিশু, আফ্রিকায় ৫২০ মিলিয়ন শিশু, পূর্ব এশিয়ায় ৪৫০ মিলিয়ন শিশু বাড়ির আঙিনায় বায়ুদূষণের শিকার হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণের চিত্রও তুলে ধরা হয়। জ্বালানি, কয়লা, কাঠ, পশুর বিষ্ঠা দিয়ে রান্নার ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া ও তাপে ঘরে বায়ুদূষণ হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের কম আয়ের পরিবারের শিশুরাই এর বেশি শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ শুধু শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষতি করে না। এটি শিশুদের মস্তিষ্ককে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, শুধু কল-কারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়াই নয়, বাড়ির আঙিনায় বা ঘরে যে চুলায় রান্না হচ্ছে, সেই চুলার ধোঁয়াও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের শিশুরাই এতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
সচেতনতার অভাবেও শিশুরা দূষিত ধোঁয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য উন্নতমানের চুলা ব্যবহার করতে হবে, যাতে ক্ষতিকর ধোঁয়া বের হতে না পারে। কিন্তু দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের পক্ষে সেটি কতটা সম্ভব, এটি নিয়ে ভাবতে হবে। শিশুরাই আগামীর বাংলাদেশ। তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। আবারও কবি সুকান্তের শরণ নিয়ে বলতে হয়, এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে যেকোনো মূল্যে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট