ইসহাক খান । । খোলা বাজার২৪, রোববার, ২৪ জুলাই ২০১৬: পাঠান সম্রাট শেরশাহ দরবারে পারিষদ নিয়ে বসে আছেন। তখনো তিনি দিল্লির সম্রাট হননি। ভারতবর্ষের কিছু কিছু অঞ্চল তিনি দখল করেছেন। তাঁর লক্ষ্য দিল্লির সিংহাসন।
এ সময় একজন সেনাপতি দরবারে এলে শেরশাহ তাকে চারপাশের খবরাখবর জিজ্ঞেস করলেন। সেনাপতি কুর্নিশ করে বললেন, ‘জাঁহাপনা, বাজারে লোকজন বলাবলি করছে আপনি নাকি অচিরেই দিল্লি আক্রমণ করবেন।’
সম্রাট শেরশাহ উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভারতবর্ষ হলো গুজবের দেশ।’
ঠিকই বলেছেন সম্রাট শেরশাহ। গোটা ভারতীয় অঞ্চলের মানুষ গুজব ছড়িয়ে আনন্দ পায়। আমাদের দেশে বোধ করি এই প্রবণতা একটু বেশি।
আমার নিজের গ্রামে এই গুজব ব্যাপারটি অনেক বেশি। আমার এক চাচি মজা করে বলেছিলেন, ‘সব গাঁয়ে ধুলা ওড়ে। আর এই গাঁয়ে কাদা ওড়ে।’
চাচি শুধু নিজের গাঁয়ের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশেই ধুলার পরিবর্তে কাদা ওড়ে। এখানে গুজবের ডালপালা মেলতে সময় লাগে না। ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর সেই ধারণা আরো পোক্ত হয়েছে। ২ জুলাই ছিল রাইটার্স ক্লাবের লেখকদের সাপ্তাহিক আড্ডা। সেই আড্ডায় ময়মনসিংহ থেকে একজন কবি যোগ দিতে আসছিলেন। বাসে ওঠার পর তিনি ঢাকার একজন কবিকে ফোন করে খবরাখবর জিজ্ঞেস করলে ঢাকার কবি তাঁকে ঢাকায় আসতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। আমরা কেউ ঘরের বাইরে যাচ্ছি না। আপনিও ফিরে যান। আজ আর রাইটার্স ক্লাবের সাপ্তাহিক আড্ডা হবে না।’
অথচ আড্ডা ঠিকই হয়েছে। এবং আড্ডার সময় ময়মনসিংহের সেই কবি ফোন করে তাঁর না আসার কারণটি জানালে আমরা ভীষণ অবাক হই। পাশাপাশি এই গুজব শুনে আমরা উচ্চ স্বরে হেসে ওঠি।
বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ থেকে আইএসের নামে মুহূর্তে দায় স্বীকার করে বার্তা দেওয়া হয়। তাতেই গুজবে বিশ্বাসী বাঙালি জাতি কোত কোত করে গিলে খায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যত বলেন এ দেশে আইএস নেই—তত আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে অহেতুক মজা করি। নানা ধরনের ব্যঙ্গ মন্তব্য করি। তার পদত্যাগও চেয়ে বসেন কেউ কেউ। অথচ আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা ‘আমাক’-এর বরাতে ১৫ জুলাই জানানো হয়েছে বাংলাদেশে ঘটমান জঙ্গি হামলার অনেক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক নেই। (সূত্র : কালের কণ্ঠ)
খবরে আরো বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে যত হত্যা হয়েছে তার মধ্যে ১৬টির দায় স্বীকার করেছে। এই খবরটি বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে আসে যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’-এর মাধ্যমে। তবে গত ১৫ জুলাই ‘আমাক’ যে তালিকা দিয়েছে, তাতে পাঁচটি হত্যার দায় তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এসব হামলার মধ্যে রয়েছে, ঝিনাইদহের হোমিও চিকিৎসক ছমির উদ্দিন হত্যাকাণ্ড, একই জেলার শিয়া মতাবলম্বী আব্দুর রাজ্জাক হত্যাকাণ্ড, গাইবান্ধার ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত হত্যাকাণ্ড, বান্দরবানের বৌদ্ধ ভিক্ষু মং শৈ উ হত্যাকাণ্ড ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ড। তবে এই তালিকায় গুলশান হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করা হয়েছে।
কথা হলো, দেশে আইএস আছে কি নেই। আইএসের নিজেরই পা রাখার জায়গা নেই। সর্বত্র তারা উচ্ছেদ হয়ে দাড়ি কেটে বোরখা পরে পালাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ মনে করেন দেশে আইএস আছে। আমরা বলতে চাই, তারা আইএস নয়। তারা দেশীয় জঙ্গি। যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায়। যারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারে। তারা কারা সেটা বোধ করি দেশবাসী জানে। এই সাধারণ বিষয় জানার জন্য রাজনীতিতে পিএইচডি করার দরকার পড়ে না। সামান্য চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়, কারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য কোটি কোটি টাকায় বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে ঘরে বসেই ইউরোপ-আমেরিকায় যোগসূত্র তৈরি করা যায়। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স।’ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে, তারা সামান্য একটা ইন্টেলিজেন্স ভাড়া করতে পারবে না, তাই কি হয়?
তাদের এই পলিসি কৌশলগত কারণে খুবই কার্যকর। নিজেদের কোনো দায় থাকল না। সব দায় গিয়ে পড়ল আইএসের ওপর। মাঝখান থেকে তাদের কার্যসিদ্ধি হয়ে গেল।
তাদের উদ্দেশ্য অতি সরল। তারা দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করে বিশ্ববাসীকে দেখাতে চায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণে বাংলাদেশে আজ এই নাজুক অবস্থা। এ কারণে তারা নিরীহ বিদেশিদের হত্যা করছে। যাতে বিদেশিরা এ দেশ থেকে চলে যায়। এটা যে রাজনৈতিক হত্যা, সেটা বিদেশিরা না বুঝলেও আমরা দেশীয় বাঙালিরা ঠিকই বুঝি। যারা এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে, তাদের বড় নেতারা আজ ফাটকে আটকা পড়েছে। তারা জানে তাদের নেতাদের রক্ষা নেই। মৃত্যুর আগে তাই তারা মরণ কামড় দিতে চেষ্টা করছে।
চোরে চোরে যেমন মাসতুতো ভাই, তেমনি জঙ্গিদের সম্পর্ক। তাদের উদ্দেশ্য যেহেতু একই, তাহলে সম্পর্ক তৈরি হতে বাধা কোথায়? আইএস যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে তুমুল হট্টগোল পাকিয়েছে। অতএব তাদের নাম বললে হামলাটা ওজনদার হয়। নিজেদের নাম প্রকাশে এই জঙ্গিদের সাহস নেই। যারা পেছন থেকে চাপাতি চালায়, তারা কাপুরুষ। বীর কখনো পেছন থেকে আক্রমণ করে না। এই কাপুরুষরা পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মুসলমানের সহানুভূতি আদায় করতে চাচ্ছে। কিন্তু এই অমানুষরা জানে না, এই মাটি অত্যন্ত উর্বর। এখানে প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার বীরের জন্ম হচ্ছে। এ দেশে বীররাই বরমাল্য পায়। কোনো কাপুরুষের গলায় এই জাতি বরমাল্য দেয় না। ভবিষ্যতেও দেবে না। যেমন দেয়নি গোলাম আযমকে, খন্দকার মোশতাককে, নিজামীকে, মীর কাসেমকে। যারা জঙ্গিবাদে নেমেছে, তারা যদি মনে করে থাকে দু-চারজন বিদেশি ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে মেরে তারা মীর কাসেমকে বাঁচাতে পারবে—তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। তারা যতই আইএসের নাম ব্যবহার করুক, দেশবাসী জানে তারা আইএস নয়, তারা জেএমবি, তারা আনসারুল্লাহ আল ইসলাম, তারা হিযবুত তাহরীর। তারা নিজেদের যত বাহাদুর মনে করুক। তারা বাহাদুর নয়। জাতি জেগে উঠলে এদের পিষে মারতে সময় লাগবে না। অতএব জঙ্গি নামধারী বাহাদুররা সাবধান। তোমাদের সামনে মরণ ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে জাতি। আরেকটু সামনে এগোলে সেই ফাঁদে ধরা পড়বে। অতএব বুঝেশুনে পা ফেল।
লেখক : গল্পকার, টিভি নাট্যকার