Sat. Jun 14th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার ২৪, সোমবার, ০১জুলাই,২০১৯ঃ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিরোধ চলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিরোধ মোকাবেলায় ভুল পথে এগোচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। তারা বাণিজ্যযুদ্ধের আনাড়ি কৌশল প্রয়োগ করছে, যা উনবিংশ শতকে প্রযুক্ত হতো। অথচ এমন কৌশল নেওয়া উচিত, যাতে একবিংশ শতকেও যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে নেতৃস্থানে রাখা যায়। চীনের চ্যালেঞ্জকে রক্ষণাত্মক কৌশল দিয়ে ঠেকানো যাবে না, শুধু অভ্যন্তরীণ পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায়ই তা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বনেতৃত্ব পুনর্বহাল করার জন্য এবং তার অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য সুদূরপ্রসারী কৌশল দরকার, যা শুধু চীনের আচরণ-পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করবে না, যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রতিযোগিতা-সক্ষম করে তুলতে হবে।

বছরের শুরুতে একবার বাণিজ্য-যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। আবার উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত কয়েক মাসে হোয়াইট হাউস চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক শত বিলিয়ন ডলার বাড়িয়েছে। টেক-জায়ান্ট হুয়ায়েইর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। চীনও পাল্টা শুল্ক চাপিয়েছে, এখন তারা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ধারণা সঠিক : চীনের ‘উচ্চ-প্রযুক্তি বাণিজ্যনীতি’ মার্কিন অর্থনীতির প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিছু উচ্চ প্রযুক্তি খাতে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকাতে চায় চীন। চীনকে ঠেকাতে হবে—ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধারণাও ঠিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা পরিকল্পিতভাবে নিয়ে মোকাবেলায় নামেনি। চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের কৌশল নিম্নচিন্তাপ্রসূত। এতে মার্কিন কম্পানিগুলো চীনের বাজারে আরেকটু বেশি অভিগম্যতা পাবে; বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমবে। কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধিতে মার্কিন কম্পানি, ব্যবসা, ভোক্তা ও কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। মার্কিন মিত্ররা বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে বিশ্বমন্দার ঝুঁকি বাড়ছে।

অধিকতর ভালো সমাধান কিন্তু আছে। ইতিহাস সাক্ষী। বাইরের অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক চাপ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে সর্বদা নিজেকে বিনিয়োজিত করেছে। বর্তমান প্রশাসনের কৌশলগত ভুল হলো, তারা চীনের ওপর অতি বেশি ফোকাস করেছে; যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নজর বলতে গেলে নেই। নিজের ঘরকে সঞ্জীবিত করতে হবে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক চাপানোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা, অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগ করা। মিত্রতা জোরদার করতে হবে। দক্ষ কর্মী ও উদ্যোক্তা আকর্ষণ করতে হলে অভিবাসন নীতির সংস্কার করতে হবে। সঠিক কৌশল প্রয়োগের সূচনা হতে হবে নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে। ট্রাম্প প্রশাসন আধুনিককালের অন্য যেকোনো প্রশাসনের চেয়ে সরকারে বিজ্ঞানের ভূমিকাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কমিয়েছে। গত নভেম্বরে ফেডারেল সরকার ‘ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাসেসমেন্ট’ প্রকাশ করে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট সেটিকে নাকচ করে দেন। সরকারের বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন কমিটিকে প্রশাসন অবজ্ঞা করেছে অথবা নিষ্ক্রিয় করেছে। এ ধরনের পদক্ষেপ ক্ষীণদৃষ্টিপ্রসূত। অনেককাল ধরে যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিজ্ঞানে সরকারি বিনিয়োগ বিশাল অর্জন এনে দিয়েছে। কয়েক দফায় ব্যাপক আর্থিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউটগুলোতে প্রতি ১০ লাখ ডলারের সরকারি অনুদান বেসরকারি খাতে ৩০ লাখ ডলারের মূল্য সংযোজন করেছে।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্মৃতিভ্রংশ রোগ দেখা দিয়েছে; এসব অর্জনের কথা মনে নেই। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে (জিডিপির সাপেক্ষে) সরকারের ব্যয় ১৯৬০-এর দশকে ছিল প্রায় ২ শতাংশ; এখন ০.৭ শতাংশে নেমেছে। ট্রাম্প সর্বসাম্প্রতিক বাজেটে বিজ্ঞান ও চিকিৎসা-গবেষণা খাত থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ছেঁটে ফেলতে বলেছেন। অতীতে কংগ্রেস এমন ছাঁটাই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। গত বছর কংগ্রেস গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ অনুমোদন করে। কিন্তু চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো অনেক সহায়তা দিতে হবে। ১৯৯১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চীন গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় ৩০ গুণ বাড়িয়েছে; ২০০০ সাল থেকে বছরে গড়ে ১৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। ফলও মিলেছে। ন্যাশনাল সায়েন্স বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, চীন সম্ভবত গত বছর গবেষণা খাতে ব্যয়ের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে গেছে। আর যদি না-ও হয়ে থাকে, শিগগির তারা টপকাবে।

মৌলিক গবেষণা ও উন্নয়নবিষয়ক নতুন জাতীয় কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাযুক্তিক শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। শুধু বেসরকারি খাত চীনের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। যদি ফেডারেল সমর্থন-সহায়তা এবং সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সহযোগিতা বাড়ানো হয়, তবেই নতুন প্রযুক্তির বিকাশে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া শিক্ষা খাতে দীর্ঘয়োদি বিনিয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তির গোলমেলে প্রভাব, অভিঘাত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রযুক্তির কারণে বেকারত্ব যাতে দেখা না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা