খােলাবাজার২৪,বুধবার,০৮জানুয়ারি,২০২০ঃ আমাদের বাংলাদেশ বৈচত্রময় এক আবহাওয়ার দেশ। আমাদের রয়েছে ছয়টি বৈচিত্রময় ঋতু। আর এই প্রত্যেক ঋতুর রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। ছয়টি ঋতুর অন্যতম একটি ঋতু হচ্ছে হেমন্ত। আর এই হেমন্তের প্রস্থানে আগমন ঘটে শীতের।
এই শীতে একসময় ব্যস্ত সময় পার করতো খেজুরের রস সংগ্রহকারী গাছিরা। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই মিষ্টি রোদ দেখে মিলতো গাছিদের রস বিক্রির দল। তবে সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ এবং গাছের রস। এখন আর দেখা পাওয়া যায়না গাছিদের দল বেধে রস বিক্রির হাকডাক। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু এ পানীয় এবং খেজুর গাছ।
শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে মিষ্টি সুস্বাদু খেজুরের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। কিন্তু এখন আর মিষ্টি রোদে তেমন একটা পাওয়া যায়না শীতরে সুস্বাদু পানীয় খেজুরের রস।
শীত মৌসুমের শুরুতেই কালীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজে ব্যাস্ত সময় পার করেন গাছিরা। শীত মৌসুমের প্রতিদিনই সকালে গাছিদের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে দেখা যায়। এক সময় এই পেশার ওপর অনেক মানুষ নির্ভরশীল ছিল । তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে খজেুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় এই খেজুরের রসের ঐতহ্যি দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে।
এক সময় কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর পরিমানে খেজুর গাছ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সভ্যতার ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে খেজুর গাছের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। সেই সাথে কমে গেছে রস সংগ্রহের গাছির সংখ্যাও।
খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের নিয়ম হলো প্রথমে খেজুর গাছের মাথার কিছু অংশ ভালো করে পরিস্কার করে গাছের ভেতরের রস বের করার জন্য গাছের সাদা অংশ বের করতে হবে। এরপর পরিস্কার করা সেই সাদা অংশ থেকে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় মাটির পাত্র যেমন ঘটি, কলসি ইত্যাদি দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। ছোট বড় বিভিন্ন রকমের খেজুর গাছে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে গাছিদের কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজ করতে হয়। গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিস্কার করে ছোট-বড় কলসি বাঁধে রসের জন্য।
আবার কাকভোরে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ এই রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাট-বাজারে (কাঁচা রস)খাওয়ার জন্য বিক্রয় করে আবার কেউ সকালেই এই রস দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও রসালু গুড় তৈরী করার কাজ শুরু করেন। গ্রামের অনেক মানুষ শীতের সকালে সুস্বাদু এই খেজুরের রস ও খেজুর রসের তৈরি গুড় নেয়ার জন্য অপক্ষোয় থাকে। যা দিয়ে তৈরী হয় মুখরোচক খাবার পায়েস ও হরেক রকমের পিঠা পুলি।
সরেজমিনে কথা হয় কালীগঞ্জ উপজেলার ছৈলাদী গ্রামের গ্রামেরর সাইফুল ইসলামের(৩৫) সাথে। সে জানায়, ছোট বেলায় অনেককে রস সংগ্রহ করতে দেখেছে সে। তখন প্রচুর রস আসতো বাড়ীতে। খেজুর গুড়ের গন্ধে মৌ মৌ করতো পুরো বাড়ি কিন্তু বর্তমানে গাছের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। একসময় তার বাবা কয়েকশো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতো কিন্তু এ বছর মাত্র ২০- ২৫ টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছে।
রস সংগ্রাহক মাজুখান গ্রামের আরিফ বলেন, আগে অনেক গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতাম কিন্তু এখন গাছও নাই তেমন রসও সংগ্রহ করতে পারিনা। কয়েকটা গাছ কেটেছি শুধু নিজের পরিবারের খাওয়ার জন্য। গাছ তো নাই তাই আগের মত রস সংগ্রহ সম্ভব হয়না।
ছাবেদ আলী মুন্সী বলেন, প্রায় ৪০-৪৫ বছর ধরে রস সংগ্রহ করে আসছি। পূর্বের তুলনায় দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এতে আমরা আর্থিক ভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।
সাধারণত একটি খেজুর গাছ রসের উপযুক্ত হতে প্রায় ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। আর একটি গাছ থেকে রস পাওয়া যায় ২০-২৫ বছর পর্যন্ত। তবে প্রতিটি গাছ থেকে কি পরিমাণ রস পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে গাছির দক্ষতা এবং গাছের উপর।
খেজুরের রস একটি উপকারী পানীয়। এতে রয়েছে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি। এই রসকে প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিং ও বলা যেতে পারে। এই রসে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। গুড়ে প্রচুর পরিমান আয়রন থাকে যা হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে।
সাধারণত যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, খেজুরের রস তাদের জন্য দারুণ উপকারী। খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ।
খেজুরের রস চুলায় জ্বাল দিয় তৈরি করা হয় পাটালী গুড়। খেজুর রসের এই নতুন পাটালী গুড় দিয়ে তৈরি করা হয় মজাদার শীতকালীন বিভিন্ন রকমের পিঠা ও পায়েশ। খেজুর রসের পাটালী গুড় থেকে তৈরি জনপ্রিয় পিঠার মধ্যে ভাঁপা পিঠা, খেজুরের রসের দুধচিতই পিঠা সকলের কাছে প্রিয়।
জনসাধারণের সাথে কথা বললে তারা আফসোস করে বলেন, আগে শীতেরে দিন আসলে মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রস খেতাম। কিন্তু এখন সারা গ্রাম খুজেও কোথাও খেজুরের গাছ এবং গাছি কারোই সন্ধান পাওয়া যায় না।
তাই আমাদরে সকলেরই খেজুর গাছ লাগানোর দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আর তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খেজুরের রসের কথা শুধু বই পুস্তকে পড়বে কিন্তু বাস্তবে তা পাবেনা।