শনি. মে ৪, ২০২৪
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

‘খােলাবাজার ২৪,রবিবার,০৭জুলাই,২০১৯ঃ রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের এই স্লোগান অনেকটা ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’-এর মতোই। দুর্নীতি যেন এ কারাগারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে! এক হাত জায়গার ‘ভাড়া’ ৩ হাজার টাকা। কম্বলের জন্য ৫ হাজার টাকা। গরুর মাংস কেজি এক হাজার টাকা। মুরগীর মাংস ৭’শ টাকা কেজি। পুটি মাছের কেজি ১৬’শ টাকা। আর শিশুদের খাবার না দিয়েই রাখা হয়। হাসপাতাল যেন আবাসিক হোটেল। এমন অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের।

উচ্চ পর্যায়ের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব অনিয়ম-দূর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। এতে জড়িত ২৬ কারারক্ষীকে বদলি করা হয়েছে। বরখাস্ত হয়েছেন সর্ব প্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের অনিয়ম-দূর্নীতিসমূহ তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্যে কারা অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করা হয়। তিনি সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপ-সচিব মো: মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। এই কমিটি গত ৬ এপ্রিল ৫১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তে বন্দি বেচা-কেনা, সাক্ষাত বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, খাবার বাণিজ্য, চিকিৎসা বাণিজ্য এবং জামিন বাণিজ্যের প্রমান মিলে। এসব থেকে বিপুল পরিমান অর্থ আদায় করে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কারারক্ষিদের বিরুদ্ধে ভাগ-ভাটোয়ারার অভিযোগের সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কারাগারে প্রথম বন্দীদের যেখানে রাখা হয় তাকে ‘আমদানি কক্ষ’ বলা হয়। পরে বন্দীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘বিক্রি’ করা হয়। ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করে পুরাতন বন্দি ও কারারক্ষীরা। ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালে চিকিৎসার নামে বিক্রি হয়। চিকিৎসার জন্যে মাসে ১০/২০ হাজার টাকা প্রদান করতে হয়। অন্যান্য ওয়ার্ডে থাকতে হলে ৫-৬ হাজার টাকা দিতে হয়। কারা কর্মকর্তাদের অর্থ দিয়ে ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় পুরনো বন্দীরা। বন্দী অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে চালানো হয় নির্যাতন। আটকিয়ে রাখা হয় বাথরুমে। প্রতি ওয়ার্ডে এক হাত পরিমান জায়গার জন্যে দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। মোটা কম্বল ও অতিরিক্ত কম্বলের জন্য ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। তল্লাশীর সময় মাদকদ্রব্য পাওয়া গেলে তা সর্ব প্রধান কারারক্ষি আবদুল ওয়াহেদ’র নিকট রাখা হয়। মাদক কারা অভ্যন্তরে প্রবেশের ক্ষেত্রে গেইট অর্ডারগন এবং কারা অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্যে গোয়েন্দা কারারক্ষীগণ সম্পৃক্ত থাকে।

খাবার অযোগ্য সিদ্ধ করা আটার রুটি কোনোভাবে গরম করে বন্দীদের দেয়া হয়। শিশুদের মায়েরা অভিযোগ করেন, প্রতিদিন শুধুমাত্র ছোট গ্লাসে একবার করে পানি মিশ্রিত নিম্নমানের দুধ শিশুদেরকে দিয়ে থাকে। সারাদিনে আর কোনো খাবার দেয়া হয় না।

প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, প্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি কারা হাসপাতাল থেকে দুধ তার মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় বলে স্বীকার করেন। এসব নিম্নমানের খাবার সরবরাহের সাথে সর্বপ্রধান কারারক্ষী, ডেপুটি জেলার, জেলার এবং জেল সুপার সরাসরি জড়িত।

কারাগারের নিয়ন্ত্রনে ২টি ক্যান্টিন রয়েছে। একটি কারাগারের ভেতরে, অন্যটি বাইরে। বাইরের ক্যান্টিনে কোন মূল্যতালিকা নেই। ভেতরের ক্যান্টিনের পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। মূল্যতালিকা থাকলেও নির্ধারন ছিল না। ৩০ টাকার আড়াই’শ গ্রামের লেমন পানির দাম ৩০ টাকা। ৩০ টাকার মাম দেড় লিটার ও ফ্রেস ২ লিটার পানির মূল্য ১৪০ টাকা। ১৪ টাকার আকিজ বিড়ির প্যাকেট ৩০ টাকা, ২০৯ টাকার বেনসন (ছোট প্যাকেট) ৩০০টাকা, গোল্ডলিফ সিগারেট (বড় প্যাকেট) ১৪৮ টাকার স্থলে ২২০ টাকা, ৪৪ টাকা কেজির চিড়া ১০০টাকা, ৪৯ টাকা কেজির চিনি ১০০ টাকা, প্রতিটি ডিম ৮ টাকার বদলে ২০ টাকা, ২০ টাকার কেজির আলু ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ৫০ টাকার বদলে ৪’শ টাকা কেজি, পুটি মাছ এক কেজি আড়াইশো-তিনশো টাকার বদলে ১৬০০ টাকা, ৩১ টাকা দামের ছোট লাক্স সাবান ৪০ টাকা, ১০ টাকার পরোটা ২০ টাকা। ক্রয়কৃত মালামালের বিপরীতে মুল্য পিসি (প্রিজনার ক্যাশ) কার্ড থেকে কর্তন করা হয়। শুধুমাত্র কর্তনকৃত মোট টাকার পরিমাণ থাকে। কোন পন্যের নাম লেখা থাকে না।

জানা যায়, মার্চ মাসে ক্যান্টিন ও অন্যান্য উৎস থেকে কারাগারের আয় ৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৯ টাকা। ওই মাসে কারা কর্তৃপক্ষ খরচ করেছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৭ টাকা। জেলার এবং জেল সুপার ইচ্ছে মাফিক কারা ক্যান্টিনের লাভ্যাংশের অর্থ খরচ করে থাকেন।

মাসিক ১০-২০ হাজার টাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল /প্রভাবশালী বন্দীরা হাসপাতালটিকে নিজস্ব বাসাবাড়িতে পরিণত করেছে। পরিদর্শনের সময় ১২টি বেডের বন্দীরা পালিয়ে যায়। ৯ জন বন্দীকে হাসপাতালে পাওয়া যায়। কোর্টে হাজিরা শেষে বন্দীরা ফেরত আসার সময় মালামালের জন্য কারা ফটকে টাকা দিতে হয়। প্রতিটি জামা, লুঙ্গির জন্য ৩০টাকা দিতে হয়।

অফিস কলের মাধ্যমে স্বাক্ষাতের সময় অফিসে অবস্থানের জন্যে আত্মীয় স্বজনকে বন্দীপ্রতি ৫’শ টাকা দিতে হয়। কারা অভ্যন্তরের জানালা দিয়ে কথা বলার জন্যে বন্দীকে ১০০ টাকা দিতে হয়।

অফিস কল এবং সাক্ষাৎকালে টাকা আদায়ের সঙ্গে সর্বপ্রধান কারারক্ষী, প্রধান কারারক্ষী জড়িত। পরবর্তীকালে এই টাকা ডেপুটি জেলার, জেলার এবং জেল সুপারের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। বন্দীরা আদালত থেকে জামিনলাভ করলেও অর্থ প্রদান না করলে জামিননামা আটকিয়ে রেখে মুক্তি বিলম্বিত করা হয়। এর জন্য সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা দিতে হয়।

কারাগারের অভ্যন্তরের উৎপাদিত সবজি বন্দীদের দৈনন্দিন খাবারের জন্যে ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট সবজি ঠিকাদারের নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বন্দীগণের মতে, খাবারে যে সবজি দেয়া হয় তা কারাগারের জমিতে উৎপাদিত। সবজির বিপরীতে সমস্ত অর্থ ঠিকাদারের মাধ্যমে জেলার এবং জেল সুপার কর্তৃক আত্মসাত করা হয়।

প্রতিবেদনটি দাখিলের পর তদন্ত কমিটির মতামত ও সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে কারা মহাপরিদর্শকের পক্ষে অতিরিক্ত কারা মহা পরিদর্শক মোঃ বজলুর রশিদ ৫ মে চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠান। যাতে ২৬ জন কারারক্ষী নামের তালিকা দিয়ে তাদেরকে কমগুরুত্বপূর্ণ কারাগারে বদলীপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করত বলা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের জেলার এ জি মাহমুদ ২৬ জন কারারক্ষীর বদলির কথা স্বীকার করে জানান, বেনামী দরখাস্তের প্রেক্ষিতে তদন্ত হয়। এই তদন্তের পর আইজি প্রিজনের নির্দেশে তাদেরকে বদলি করা হয়েছে এবং একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। জেল সুপারের বদলিও প্রস্তাব হয়েছে।