খোলা বাজার২৪ ॥ মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫
হঠাৎ দেখি মানুষ ছুটছে। এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। চারদিক থেকে কান্নার রোল ভেসে আসছে। আমি তখন মিনার জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করতে তিন তলায় অবস্থান করছিলাম। মানুষের চাপ থেকে বাঁচতে পাশের কনফেকশনারি দোকানে প্রবেশ করি। কিন্তু মানুষের চাপে দোকানটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে তিন তলা থেকে লাফ দেই। একেবারে নিচের তাঁবুর ওপর পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের বিছানায়। এভাবেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে মিনা ট্র্যাজেডির বর্ণনা দিচ্ছিলেন রাজধানী যাত্রাবাড়ীর হাজী মো. বাবলু।
সোমবার বিকাল সোয়া ৪টায় সৌদি এয়ারলাইনসের একটি বিমানে তিন শতাধিক হাজী নিয়ে ফিরতি ফ্লাইট (এইচবি-৮০২) ঢাকায় পৌঁছে। প্রাণে বেঁচে আসায় বিমানবন্দরে অনেকে স্বজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
হাজী মো. বাবলু জানান, ওই ঘটনায় তিনি শরীরে চাপা আঘাত পান, কিন্তু কোথাও রক্তপাত হয়নি। একদিন পরেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি।
একই ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন হাজী মো. আতিয়ার রহমান। মিনা ট্র্যাজেডির বর্ণনা করে তিনি বলেন, ওই ঘটনার দেড় ঘণ্টা আগে জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করি। যখন ঘটনাটি ঘটে তখন আমি প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে।
বেঁচে যাওয়া অনেকে আমাকে বলেছেন, পাথর নিক্ষেপ নিয়ে আফ্রিকান নাগরিকের সঙ্গে এক পাকিস্তানির মারামারি হয়। এ থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। মারামারি ঘটনা শুনে পেছন দিক থেকে সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। গরমে মানুষ তখন হাঁসফাঁস করছিল। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ ছুটতে থাকেন। মানুষের প্রচ- ভিড়ের মধ্যে অনেকেই নিচে পড়ে যান। পায়ের নিচে চাপা পড়ে এসব মানুষ মারা যান। অনেকে আহত হন।
ফেনীর সোনাগাজীর হাজী আবু বকর সিদ্দিক জানান, মিনার জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করে বের হওয়ার দুটি বহির্গমনের পথ বন্ধ ছিল। পাথর নিক্ষেপ করে বের হওয়ার সময় মানুষের জট লেগে যায়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে অনেকে হুড়োহুড়ি শুরু করেন। তখন পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে অনেকে মারা যান।
রাজধানীর বাসাবোর বৌদ্ধমন্দির এলাকার বাসিন্দা হাজী সুলতান আলী বলেন, আমি তখন মিনার পাশেই অবস্থান করছিলাম। একজন ভিআইপির পাথর নিক্ষেপের কথা ছিল। তার সম্মানে দুটি রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। একটি রাস্তা দিয়ে সবাই বের হওয়ার চেষ্টা করেন। এতে প্রচ- ভিড় লেগে যায়। মানুষের চাপাচাপিতে অনেকে নিচে পড়ে যান। প“লিত হয়ে এসব হাজী মারা যান। তবে রাস্তা খোলা থাকলে এসব প্রাণহানিরা ঘটনা ঘটতো না। এখনও ৯৪ বাংলাদেশি হাজী নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানান তিনি।
বগুড়ার হাজী মতিয়ার রহমান জানান, আমি তখন মিনার ১নং গেটে অবস্থান করছিলাম। দুটি রাস্তা বন্ধ থাকায় প্রচ- ভিড়ের মধ্যে মানুষ ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। একপর্যায়ে ৬-৭ জন নিচে পড়ে যান। এরপর প্রাণ বাঁচাতে অনেকে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। এতে প“লিত হয়ে এসব হাজী মারা যান।
বগুড়ার আরেক হাজী বিজেডএম ফারুক বলেন, আমি দুই ঘণ্টা আগে জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করে আসি। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি।
এদিকে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত রোববার থেকে দেশে ফিরতে শুরু করেন হাজীরা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরব যাওয়া হাজীদের নিয়ে গতকাল সকাল সোয়া ৯টায় ফিরতি ফ্লাইট ঢাকায় ফেরার কথা থাকলেও রাত সাড়ে ৮টায় সেটি পৌঁছে। হজযাত্রীদের নিয়ে শেষ ফিরতি ফ্লাইট দেশে পৌঁছবে আগামী ২৮শে অক্টোবর।
উল্লেখ্য, গত ২৪শে সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় মিনার জামারাতে পাথর নিক্ষেপের সময় হুড়োহুড়িতে প“লিত হয়ে এ পর্যন্ত ৭৬৯ হাজীর মৃত্যু হয়েছে বলে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
এর মধ্যে ১৮ বাংলাদেশি হাজী রয়েছেন বলে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) জানিয়েছে।
এ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট এক লাখ ৭ হাজার ২৯০ জন পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে যান।