খোলা বাজার২৪,শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫: ‘আগের বার মাত্র ১৩ ভোট কম পাইয়া ফেল করছিলাম। আমার আত্মীয় নাই। স্বজন নাই। অন্য প্রার্থীর নিজস্ব ভোটই থাকে দুই আড়াই শ। তবে গতবার ফেল করলেও ভরসা হইছে। জনগণই তো আমারে ভোট দিছে। এইবার আল্লাহ চায় তো জিতমু।’
যশোরের বাঘারপাড়া পৌরসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের প্রার্থী হিজড়া সুমি এভাবেই কথাগুলো বলেন। আজ শনিবার বিকেল চারটার দিকে মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বারেও নির্বাচন করা সুমিকে যখন ফোন করা হয় তিনি তখন এলাকায় জনসংযোগে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ভোটার সংখ্যা তিন হাজার। সুমি নির্বাচন করছেন নারী প্রার্থী হিসেবে।
সুমির বাড়ি ছিল কুমিল্লায়। ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে তিনি যশোরে চলে আসেন। তাঁর বাবা মা মারা গেছেন বলে জানালেন। সুমি হিজড়া জনগোষ্ঠীর সর্দার।
সুমির কণ্ঠে ব্যস্ততা। তাঁর হিজড়া জীবন নিয়ে জানতে চাইলে বেশ খানিকটা ক্ষেপে গেলেন। বলেন,‘ আপা ভোট চাইতাছি, লাইফের হিস্টরি কওনের সময় নাই।’
ভোটে জিতলে হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রসঙ্গে সুমি বলেন, ‘জাত ভাইকে তো আর ফালাই দিব না।’
এলাকায় ভোট চাইতে গিয়ে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কি না জানতে চাইলে সুমি বলেন,‘ বাধা দিব ক্যান? আমরা বাংলাদেশের নাগরিক না? হিজড়ার ভোটে সরকার নির্বাচিত হয় নাই?’
এবারের পৌরসভা নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাতক্ষীরার কলারোয়ার হিজড়া দিথী। আজ বিকেলে তাঁকে যখন ফোন করা হয় তখন তিনিও জনসংযোগে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি প্রতিদিনের রুটিন উল্লেখ করে বলেন,‘সকাল ৭টার দিকে বাইর হই। দুপুর ১টার দিকে বাড়িত গিয়া গাওগোসল ধুইয়া আবার বাইর হই। রাত ৭ বা ৮টা বাজে ঘরে ফিরতে।’
কি বলে জনগণের কাছে ভোট চান জানতে চাইলে দিথী বলেন,‘জনগণরে কই আমার ছেলেপুলে নাই। খাওনের কেউ নাই। জিতলে আমি জনগণের সেবা করব। বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা করব। রাস্তাঘাট করব। আর্সেনিক মুক্ত কল করনের লাইগ্যা সহযোগিতা করব।’
৪০ বছর ধরে এলাকায় বসবাস করা দিথী দাবি করলেন, জনগণ তাঁকে ভালোবেসেই ভোট দেবে।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রার্থী সুমি অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন। তাঁর পেশা কৃষি ও ব্যবসা। অন্যদিকে হলফনামায় দিথী স্ব-শিক্ষিত বলে উল্লেখ আছে। তাঁর পেশা দেওয়া আছে গৃহিণী/ব্যবসা।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর দুজনের নির্বাচন করা প্রসঙ্গে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠন হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। তবে আমার মনে হয়, বিভিন্ন সংগঠনের কাজের জন্য নয়, তাঁরা তাঁদের নিজেদের অনুপ্রেরণা থেকেই নির্বাচন করছেন। আমরা আমাদের কাজের মধ্যে তাঁদের সামনে ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণগুলো তুলে ধরি। তা থেকেই তাঁরা অনুপ্রেরণা পান।’
২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ সভায় নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের আলাদা লিঙ্গ বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সালেহ আহমেদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের স্বীকৃতি পাওয়া অনেক বড় বিষয়। তবে ঘোষণাটি এখনো ঘোষণা হিসেবেই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ঘোষণাটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়নি। ফলে তা সাংবিধানিকভাবে আইনি কাঠামো পায়নি। স্বীকৃতিটি আইনি কাঠামো পায়নি বলেই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘নারী’ হিসেবে নির্বাচন করতে হচ্ছে। অন্যান্য অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
হিজড়াদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন সম্পর্কের নয়া সেতুর প্রেসিডেন্ট জয়া শিকদার বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে দুজন প্রার্থী নির্বাচন করছেন। নির্বাচন কমিশনসহ সবার উচিত এই দুই প্রার্থীকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা। ভোটারদেরও উচিত এদের ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তন করা। ভালো মনে করছে হিজড়া প্রার্থীদের ভোট দেওয়া উচিত।