খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ২৫ মার্চ ২০১৬ : অসদাচরণের জন্য কোনো বিচারককে অপসারণে সাবেক একজন বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃত্ব সংসদকে দিয়ে প্রণীত আইনের খসড়া সরকারকে দিয়েছে আইন কমিশন।
বিচারপতিদের অসামর্থ্য ও অসদাচরণ তদন্ত এবং প্রমাণের পদ্ধতি সম্পর্কিত এই আইনের খসড়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আলোকে তৈরি করেছে আইন কমিশন।
খসড়া আইনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির মতামত চাওয়া হয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তা পাওয়ার পরই এই বিষয়ে কথা বলবেন তিনি।
গত ২২ মার্চ কমিশনের ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশের সময় বহু প্রতীক্ষিত এই আইনটির খসড়া তৈরির কথা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়ে আসেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
বিচারপতিদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের সংজ্ঞা, তাদের অপসারণের পদ্ধতির বিস্তারিত উল্লেখ করে তৈরি করা আইনটির খসড়ার একটি অনুলিপি হাতে এসেছে।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে নানা ঘটনা প্রবাহে তা পরিবর্তিত হয়।
২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনে বিচারক অপসারণের ওই ক্ষমতা পুনরায় সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার পর অপসারণের পদ্ধতি নিয়ে একটি আইন তিন মাসের মধ্যে প্রণয়নের কথা বলেছিলেন আইনমন্ত্রী।
এর পরে প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সে আইনটি করা হয়নি। এখন আইন কমিশনের এই খসড়া নিয়ে সরকার আলোচনার পর আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারে।
আনিসুল হক বলেন, “আমি আগেও বলেছিলাম এ আইনটি প্রণয়নের সময় স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেব। এই আইনের স্টেকহোল্ডার হচ্ছে মাননীয় বিচারপতিগণ।
“আমি খসড়ার কপি মাননীয় প্রধান বিচারপতির অফিসে পাঠিয়েছি। তার অফিস থেকে খসড়াটি সম্পর্কে মতামত আসলে পরে প্রক্রিয়া অনুসরণ হবে।”
কী হলে অপসারণ?
খসড়া আইনে বিচারপতিদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, কারও ক্ষেত্রে যা পাওয়ার গেলে তাকে অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে।
এতে বলা হয়েছে, “অসদাচরণ অর্থ- কোনো বিচারক কর্তৃক ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিচার পরিচালনা বা রায় দেওয়া; পদমর্যাদা বা কার্যালয়ের অপব্যবহার করে আর্থিক, বস্তুগত কিংবা অন্য কোনো সুবিধা নেওয়া; নৈতিকস্খলন জনিত অপরাধ; বিচার কাজে প্রভাবিত হওয়া বা অন্যকে প্রভাবিত করা।”
ইচ্ছাকৃত ও ক্রমাগত বিচারিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা, জীবন বৃত্তান্তে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাসঙ্গিক কোনো তথ্য গোপন করলেও অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে বলে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে।
এতে অসামর্থ্য বলতে কোনো বিচারকের স্থায়ী প্রকৃতির শারিরিক বা মানসিক অসামর্থ্যতাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
কীভাবে অপসারণ?
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, যে কেউ সংসদের স্পিকারের কাছে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের অভিযোগ আনতে পারেন।
সংক্ষুব্ধ ওই ব্যক্তির অভিযোগ প্রাথমিক বিবেচনার জন্য স্পিকার ১০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে পাঠাবে।
সংসদ সদস্যদের ওই কমিটি যদি মনে করেন প্রাথমিকভাবে অভিযোগটির সত্যতা রয়েছে, তাহলে তারা স্পিকারকে লিখিতভাবে জানাবে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্পিকার সংসদে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন।
সংসদ যদি মনে করে ওই অভিযোগ তদন্ত করা প্রয়োজন, তাহলে তা তদন্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। অভিযুক্ত বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থন করে কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত বক্তব্য রাখতে পারবেন বলেও খসড়ায় বলা হয়েছে।
কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব রেখেছে আইন কমিশন।
একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতিকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হবে। সদস্য থাকবেন একজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন সম্ভ্রাস্ত নাগরিক।
কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই বিচারককে সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার বিধান প্রস্তাব করেছে আইন কমিশন।
এরপর সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি ওই বিচারকের অসামর্থ্য বা অসদাচরণের জন্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ওই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারণ করবেন।
আর কমিটির তদন্তে যদি অভিযুক্ত বিচারক নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তা প্রতিবেদন দিয়ে স্পিকারকে জানানো হবে। স্পিকার তা সংসদে উপস্থাপন করবেন।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সংসদ যদি ওই প্রতিবেদন নিষ্পত্তি না করে আবার তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলে তাহলে একই প্রক্রিয়ায় আবার তদন্ত হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক বা অসত্য অভিযোগ আনেন, তবে ওই ব্যক্তির দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অনুর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হবে।
পেছনের কথা
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ এবং তাদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল।
এরপর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে চলে আসে।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে ১৯৭৭ সালে এক সামরিক ফরমানে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
আইন কমিশন এই জডিশিয়াল কাউন্সিলকে ‘সামরিক ফরমানের মাধ্যমে একজন অবৈধ সামরিক শাসকের খেয়ালখুশি ও মর্জিমাফিক সম্পূর্ণ এখতিয়ারবিহীন ও অসাংবিধানিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
জিয়ার আমলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে ওই ধারাই চলে আসছিল।
তবে এর মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ এবং সামরিক শাসনামলে প্রণীত সব আইন ও কার্যাবলি বাতিল ঘোষণা করলে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে।
এর মধ্যে ২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাই কোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন।
মূলত সে সময়েই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়।
এরপর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিল পাস হয়।
জনগণের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আইনের এই সংশোধন বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়।
অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি দাবি করে, আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে। ক্ষমতায় ফিরলে এই সংশোধনী বাতিলের ঘোষণাও দেয় তারা।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রিট আবেদন
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে একটি রিট আবেদনও হয়েছে।
হাই কোর্টে বিচারাধীন এই রিট আবেদনে আগামী ৫ মে রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ এই আবেদনের রায় দেবে।
ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাসের পর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর রিট আবেদনটি করেন।
এতে আদালতের একটি রুল আসে। তাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করা সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইন কেন বে আইনি ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
এই রুলের উপর গত বছরের ২১ মে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসির বক্তব্য শোনে আদালত।
শুনানিতে ড. কামাল এই সংশোধনের বিরোধিতা করে বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম অংশ। জাতীয় সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে। তাই এই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি গণ্য করা যেতে পারে।