খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৪ এপ্রিল ২০১৬: তাঁদের অস্ত্রাগারে মজুদ থাকা পর্যাপ্ত ‘বারুদ’ নিয়ে পুরো টুর্নামেন্টেই গৌরব করে এসেছে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ফাইনালে আসার পথে একেকটি পর্যায়ে ব্যাট হাতে একেকজন সেই ‘আগুনে গোলা’ ছুড়েছেনও। সবারই তাই জানা হয়ে গিয়েছিল যে হয় ক্রিস গেইল, নয়তো মারলন স্যামুয়েলস, ডোয়াইন ব্রাভো, আন্দ্রে রাসেল কিংবা ড্যারেন সামিদের কারো না কারো ব্যাটেই ফাইনালে ছুটতে পারে আগুনের ফুলকি। কিন্তু কেউ যেটা জানত না, সেটা হলো এই ক্যারিবীয় দলে লুকায়িত আগুনও তো ছিল। কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল যে কার্লোস ব্রাথওয়েট নামের সেই লুকানো আগুনের তেজেই ইংল্যান্ডের প্রায় ধরা দেওয়া বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটি জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাবে! এউইন মরগানের দল বিশ্বকাপ তো জিতেই গিয়েছিল প্রায়। তাঁদের ছুড়ে দেওয়া ১৫৬ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ছক্কার বৃষ্টি ঝরাতে জানা ক্যারিবীয় দলের বিস্ফোরক ব্যাটসম্যানদেরও তো রয়েসয়ে খেলতে হচ্ছিল। কারণ কলকাতার ইডেন গার্ডেনসের উইকেটে যে বল ঠিকমতো ব্যাটেই আসছিল না। মাঝেমধ্যে বল নিচুও হয়ে যাচ্ছিল। আর এমন উইকেটে ইংলিশ বোলারদের কেউ কেউ এমন দুর্দান্ত বোলিং করছিলেন যে তাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিধ্বংসী ব্যাটিং লাইনও রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
বাঁহাতি পেসার ডেভিড উইলির নিজের প্রথম তিন ওভারের মধ্যে ১২টি ‘ডট’ বল দেওয়ার তথ্যই সেটি বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। শুধু কি তাই? ভারতের বিপক্ষে ক্যারিবীয়দের সেমিফাইনাল জয়ের নায়ক লেন্ডল সিমন্সকে (০) এবার শুরুতেই তুলে নেওয়া উইলি একই ওভারে ঝুলিতে পুরেছেন দুই বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান রাসেল (১) এবং সামিকেও (২)। তাও আবার ওই দুজনকে এমন সময়ে ফিরিয়েছেন, যখন ম্যাচ জেতানোর লড়াইয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন ২০১২-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচসেরা স্যামুয়েলসও। চার বছর আগে তিনি ‘হিরো’ হলেও এবার যেন ‘ট্র্যাজিক হিরো’ বনে যাওয়ার পথেই ছিলেন। শেষ ওভার শুরুর আগ পর্যন্ত অন্তত যে কারোরই তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কারণ ৬৬ বলে ৯ বাউন্ডারি ও দুই ছক্কায় ৮৫ রান করা স্যামুয়েলস যে তখন নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে। আর জিততে হলে তখন ৬ বলে ১৯ রানের সমীকরণও দুঃসাধ্য বলে মনে হতে শুরু করে দিয়েছে। ছক্কার বন্যা বইয়ে দিতে জানা ক্যারিবীয়দের ইনিংসে যে ততক্ষণে মাত্র তিনটি ছক্কা। তার ওপর সামি যতই বলুন তাঁদের আস্থা ছিল, তবু শেষ ওভারে স্ট্রাইকে থাকা ব্রাথওয়েটের সামর্থ্যে সন্দিহান লোকের অভাব ছিল না নিঃসন্দেহে। আর সেই সন্দেহ খুব অমূলকও তো ছিল না। এর আগে সাতটি টি-টোয়েন্টি খেলা ব্রাথওয়েটকে তিনটি ম্যাচে ব্যাটিংই করতে হয়নি। যে চারটি ম্যাচে করেছেন, রান সব মিলিয়ে ২৫। সর্বোচ্চ ইনিংসটি মাত্র ১৩ রানের। ফাইনালের মতো উত্তপ্ত কড়াইয়ে তাঁর মতো কারো পক্ষে ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং করা সম্ভব বলে হয়তো মনে হচ্ছিল না মরগানেরও। এর আগেই গুরুত্বপূর্ণ সব বোলারের কোটা শেষ করিয়ে জয়ের পথও তৈরি করে রাখায় শেষ ওভারে মরগানের সামনে ছিল দুজনের যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়ার। ৫৪ রানের ইনিংসে দলের ব্যাটিংকে টানার পর ক্যারিবীয় ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই তিন বলের মধ্যে জনসন চার্লস (১) ও গেইলকে (৪) তুলে নেওয়া জো রুট নয়তো বেন স্টোকস। মরগান বেছে নিলেন স্টোকসকে। আর তিনি বোলিং শুরু করতেই ইংলিশদের ঝলমলে স্বপ্ন রূপ নিতে শুরু করল ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। লুকায়িত আগুন ঝলসাতে শুরু করল ব্রাথওয়েটের ব্যাটে।
২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টির প্রথম বিশ্ব আসরে এই ইংল্যান্ডেরই স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ানোর মতো এক দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়েছিলেন ভারতের যুবরাজ সিং। স্টোকসকে কি এর চেয়েও বড় কিছু দিলেন না ব্রাথওয়েট? কারণ তাঁর এভাবে মার খাওয়াটা যে বিশ্বকাপ ফাইনালে, প্রায় জিতে যাওয়া বিশ্বকাপ হারানোর বেদনারও। ব্রাথওয়েট তাঁর প্রথম চার বলেই চারটি ছক্কা হাঁকিয়ে লিখে ফেলেন আরেকটি ক্যারিবীয় ক্রিকেট রূপকথা। দুই বল বাকি থাকতেই লেখা হওয়া যে রূপকথায় বিলীন হয়ে যায় ১৯৮৭-র পর আবার সেই ইডেন গার্ডেনসে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন। শেষ ওভারের প্রথম ডেলিভারিটা ছিল লেগ স্টাম্পের ওপর হাফ ভলি, ব্রাথওয়েট ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে বল ছক্কার ঠিকানায় পাঠানোর পরও জিততে ১৩ রান বাকি ৫ বলে। পরের বলে লংঅন দিয়ে দ্বিতীয় ছক্কায় হতভম্ব স্টোকসকে নির্বাক করে দিতে তৃতীয় বলেও ছক্কা, এবারের ঠিকানা লংঅফ। সঙ্গে সঙ্গেই ডাগআউট থেকে বেরিয়ে ভোঁ-দৌড়ে দুই জয়ের নায়ককে জড়িয়ে ধরতে তৈরি পুরো ক্যারিবীয় শিবির। ৩ বলে লাগে ১ রান, কিন্তু প্রথম দল হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয়বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাসে ঢুকে যাওয়াটা ব্রাথওয়েটের মারা টানা চতুর্থ ছক্কায়। সেটি ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে না যেতেই জয়োৎসবের মধ্যমণি ব্রাথওয়েট, সেই সঙ্গে ক্যারিবীয়দের ‘চ্যাম্পিয়ন’ নাচেরও। টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে এই ইংল্যান্ডকে হারিয়েই যে নাচ বাজারে ছেড়েছিলেন সামিরা! কী আশ্চর্য, তাঁরা চ্যাম্পিয়নও হয়ে ছাড়লেন। অথচ কালকের ফাইনালটি একসময় কার চেয়ে কারা খারাপ শুরু করতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছিল যেন। স্কোরবোর্ডে ২৩ রান উঠতেই যেখানে ৩ উইকেট নেই ইংল্যান্ডের, সেখানে ক্যারিবীয়দের অবস্থা আরো খারাপ।
৩ উইকেট খোয়ায় তারা ১১ রানেই। সেখান থেকে স্যামুয়েলস আর ডোয়াইন ব্রাভো (২৭ বলে ২৫) মিলে ৭৫ রানের পার্টনারশিপে বিপর্যয় সামাল দেন বটে কিন্তু তাতে আবার কম বলে বেশি রানের চাপও তৈরি হয়ে যায়। এর মধ্যে ‘চ্যাম্পিয়নস লাক’ও ছিল স্যামুয়েলসের পাশে। লিয়াম প্লাংকেটের বলে উইকেটরক্ষক জস বাটলারের ক্যাচ হয়ে ড্রেসিংরুমের পথে হাঁটাও ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু রিপ্লে দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বল মাটি থেকে গ্লাভসে তুলেছিলেন বাটলার। তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ৩৭ আর স্যামুয়েলসের ২৭। অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া সেই স্যামুয়েলসই চার বছরের মধ্যে আরেকবার ‘ম্যান অব দ্য ফাইনাল’। তবে শেষ চার বলে মারা চারটি ছক্কায় তাঁকে ‘পার্শ্বনায়ক’ বানিয়ে আসল নায়ক ব্রাথওয়েটই। তাঁর ব্যাটের ছোঁয়াতেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ এবং নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর অন্য রকম এক ‘ট্রেবল’ বা ‘ত্রিমুকুট’ জয়ও সম্পন্ন হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের, সম্পন্ন হলো লুকায়িত আগুনের তেজেই