Mon. Mar 17th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

3খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল ২০১৬: অবশেষে বিএনপির পূর্ণ মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি রেকর্ড সময় (পাঁচ বছর) এই দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তিনি ‘ভারমুক্ত’ মহাসচিব হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কারারুদ্ধ হন, কিছুক্ষণ পর জামিনে মুক্তিও লাভ করেন। এর দুই দিন পর জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের একটি অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিত থাকার কথা থাকায় সেই অনুষ্ঠানই করতে দেয়নি পুলিশ। স্পষ্টতই এসব ঘটনা এই ইঙ্গিত প্রদান করে যে তাঁর পূর্ণ মহাসচিব হওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের মনঃপূত হয়নি। এসব ঘটনা এ-ও প্রমাণ করে যে মহাসচিব পদে তাঁর নিয়োগ বিএনপির জন্য একটি সঠিক সিদ্ধান্ত।
মির্জা ফখরুল গত বছরগুলোতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অনেকবার কারারুদ্ধ হয়েছেন, বহু ঘটনায় বিএনপির বক্তব্যকে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন এবং দলের ভেতরের বিভিন্নমুখী কোন্দলের ঊর্ধ্বে নিজেকে রাখতে পেরেছেন। বিএনপির মতো এত বিশাল একটি দলে তাঁকে এত বছর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, এটি তাই তাঁর অযোগ্যতা হিসেবে দেখার তেমন সুযোগ নেই। এটি বরং বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতার প্রতিফলন বলা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, মহাসচিব পদে তাঁর নিযুক্তি দল এবং দেশের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে কি না? আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিতেও মহাসচিব পদের খুব বেশি গুরুত্ব নেই। বিএনপির গঠনতন্ত্রে মহাসচিবের কার‌্যাবলি ও ক্ষমতা নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁকে চেয়ারপারসনের পরামর্শক্রমে কাজ (যেমন বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি অনুমোদন এবং দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটির মিটিং আহ্বান) করতে হবে বলা হয়েছে। এটি ঠিক যে দলের নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন ফোরামে পদাধিকার বলে তাঁর অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে, দলের কাউন্সিলে তাঁর একটি নিজস্ব প্রতিবেদন পেশ করার বিধান আছে। কিন্তু বিএনপির কাউন্সিল ও সভা খুবই অনিয়মিত এবং এসবে দলের চেয়ারপারসনের আধিপত্য খুবই বেশি। ফলে মহাসচিবের ক্ষমতা এখানে যথেষ্ট কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
তবে গঠনতন্ত্রই সব কথা নয়। বিএনপির ইতিহাসে গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত স্বল্প বা সুপ্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে কয়েকজন মহাসচিব দলের বিকাশ ও সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আবার দলের সংকটকালে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র জন্যও তাঁদের কেউ কেউ সমালোচিতও হয়েছেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে তাঁদের তুলনায় মির্জা ফখরুলের মহাসচিব হিসেবে সাফল্য অর্জনের পথ কিছুটা হলেও বেশি দুরূহ।
২.
নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার সূচনালগ্নে বিএনপির মহাসচিব ছিলেন কে এম ওবায়েদুর রহমান। তিনি ক্যারিসমেটিক নেতা ছিলেন, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাও ছিল বহু বছরের। কিন্তু তিনি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির সংকটকালে কিছু নেতাকে নিয়ে দল থেকে বের হয়ে গিয়ে বিএনপিকে নতুন সংকটে ফেলেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত মহাসচিব ছিলেন ব্যারিস্টার সালাম তালুকদার। তিনি মহাসচিব হওয়ার পর জেলা ও থানা পর্যায়ে কাউন্সিল সুসম্পন্ন করে দলে সাংগঠনিক সচলতা বৃদ্ধি করেন। বিএনপি যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অভাবিত সাফল্য অর্জন করে এর পেছনে এসব সাংগঠনিক তৎপরতার ভূমিকা ছিল।
ব্যারিস্টার সালাম তালুকদারের আকস্মিক মৃত্যুর পর আবদুল মান্নান ভূঁইয়া নতুন মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সুপরিচিত রাজনীতিবিদ ছিলেন, বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিম-লেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু তিনি ওয়ান-ইলেভেন সময়কালে দলের নেত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং একপর্যায়ে নতুন বিএনপি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে বহিষ্কৃত হন। মহাসচিবদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন বিরূপ অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো মান্নান ভূঁইয়ার স্বল্পকালীন উত্তরসূরি খন্দকার দেলোয়ারের মৃত্যুর পর নতুন মহাসচিব নিয়োগে এবার এত দীর্ঘ সময় নেওয়া হয়। তবে এটি একটি কারণ হতে পারে, একমাত্র কারণ সম্ভবত নয়। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচন এবং সাংগঠনিক ও আন্দোলনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘসূত্রতার বহু উদাহরণ রয়েছে। এই স্থবিরতা কাটানোই সম্ভবত নতুন মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলের বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
৩.
পূর্বসূরিদের তুলনায় মির্জা ফখরুলের দায়িত্ব কতটা চ্যালেঞ্জপূর্ণ তা বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থা ও সংকটকে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। বিএনপির রাজনৈতিক সংকট বলতে দুটি বিষয়কে অনেকে খুব গুরুত্ব দিয়ে উত্থাপন করে থাকেন। এর একটি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক সম্পর্ক। এই সম্পর্ক দেশের অনেক মানুষকে হতাশ করলেও ভোটের রাজনীতিতে এর তেমন প্রভাব আসলে নেই। এর একটি বড় প্রমাণ হচ্ছে ২০১২-১৩ সালে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে (এমনকি ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে) অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপির বিজয়। বিএনপির সংকট হিসেবে অনেকে ২০১৫ সালের সহিংস আন্দোলনের নেতিবাচক প্রভাবের কথাও বলে থাকেন। তবে এ কারণে বিএনপি আসলেই কতটুকু জনসমর্থন হারিয়েছে, তা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।
বিএনপির প্রকৃত সংকট যত না সমর্থনের ক্ষেত্রে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে নেতৃত্ব পরিচালনা ও সাংগঠনিক সচলতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতা (যেমন ২০১৩ সালে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ, শেখ হাসিনার আলোচনার প্রস্তাব, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পরের অবস্থান ইত্যাদি প্রসঙ্গে) এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের ব্যাপকসংখ্যক সমর্থককে মাঠে নামাতে ব্যর্থতা (যেমন খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ থাকার বিভিন্ন সময়ে) দলের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতীতে দলের বিভিন্ন সংকটকালে নেতৃত্বদানের কাজটি বেগম খালেদা জিয়া প্রায় এককভাবে করেছেন, বহু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। কিন্তু বয়স, সরকারের দমননীতি ও পারিবারিক জীবনে বিভিন্ন ট্র্যাজেডির কারণে তিনি সম্ভবত আগের মতো কর্মক্ষম নেই। একটা সময় তারেক রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতা দলের জন্য একটি সম্পদ ছিল, কিন্তু বিভিন্ন মামলা ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়া এবং দীর্ঘকালীন দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে তিনিও দলের জন্য সেভাবে আর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ইতিমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনেকে বার্ধক্য বা সরকারের দমননীতির শিকার হয়ে তাঁদের কার্যকারিতা হারিয়েছেন। বেগম জিয়ার আশপাশের কিছু নেতা এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিশ্বস্ততা নিয়েও নানা গুঞ্জন রয়েছে দলের ভেতর-বাইরে।
মির্জা ফখরুলের এসব ঘাটতি মোকাবিলার কাজটি করতে হবে, কিন্তু এ জন্য তিনি কতটা ক্ষমতাবান, তা নিয়ে প্রচুর সংশয় রয়েছে। তিনি একসময় বাম রাজনীতি করতেন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, দলের ভেতর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু তাঁর গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য নয়, তাঁর অবস্থান ও মতামত দিয়ে দলকে প্রভাবিত করার জন্য তা যথেষ্ট নয়।
বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের আরেকটি বড় দিক হচ্ছে আন্দোলন কর্মসূচিতে কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে অনীহা। সরকারের অনুমতি নিয়ে জনসভা হলে সেখানে ঠিকই বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ঢল নামে, কিন্তু সরকারের হুংকার থাকলে বিশেষ করে ঢাকাতে তাঁদের আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে গুম, হত্যা, গণগ্রেপ্তার, গণহারে মামলাসহ সরকারের বিভিন্ন দমননীতির কারণে এটি হচ্ছে। কিন্তু এর আরও কারণও থাকতে পারে। বিএনপিতে বহু বছর ধরে স্থানীয় পর্যায়ে কাউন্সিল হচ্ছে না, দীর্ঘদিন ধরে এর শাখা ও সহযোগী সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব আসছে না, বহু ক্ষেত্রে দলের নির্যাতিত কর্মীদের পাশে আইনি, আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দিতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে। এসব সমস্যা দূর করে হোক বা অন্য যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকৌশল নিয়ে হোক দলের মধ্যে নতুন আশাবাদ ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করার উদ্যোগ দলকে গ্রহণ করতে হবে। এই বিশাল দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে বিএনপির মহাসচিব করতে পারবেন কি না, দলের নেতৃত্বের দুই কেন্দ্রের (ঢাকা ও লন্ডনের) সমন্বয়ই বা তিনি কীভাবে করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
৪.
বাংলাদেশে বর্তমানে গণতন্ত্র ও সুশাসনের যে গভীর সংকট চলছে তার একটি বড় কারণ শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। আওয়ামী লীগের বিকল্প বাম দল বা অন্য কোনো নতুন দল হোক, এ ধরনের উ”চাশা অনেকের থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এর কোনো সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন আনুকূল্য সত্ত্বেও ভোটের রাজনীতিতে সরকারের সঙ্গে ও বাইরে থাকা বাম দলগুলোর করুণ অবস্থা বহু সময়ে লক্ষ করা গেছে। জাতীয় পার্টিও বর্তমানে একটি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক দল। সাংগঠনিকভাবে বিশেষ করে আন্দোলন কর্মসূচিতে বিএনপির দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠলেও দলটির এখনো ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা বা সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা এখনো একমাত্র বিএনপিরই রয়েছে।
বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ এখন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য বা রাজি করানো। অথবা আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে একে যতটা সম্ভব সুষ্ঠু করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। বিএনপিকে একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কমিটেড দল হিসেবেও নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করার কাজটি করতে হবে। প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে পারেন। তবে তাঁকে দলের শীর্ষ ও সিনিয়র নেতারা সহযোগিতা না করলে তাঁর নিয়োগ বিএনপি বা দেশের জন্য তেমন কোনো সুফল বয়ে আনবে না।