খোলা বাজার২৪,শনিবার,০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬: চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে পৃথকভাবে দায়ের করা দুটি মামলার চার্জশিট হচ্ছে। এর একটি ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দায়ের করা হয়েছিল। ওই মামলায় বেসরকারি টেলিভিশন একুশে টিভির তৎকালীন কর্ণধার আবদুস সালামসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পরে মামলাটির তদন্তভার যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবির) কাছে। এ মামলার তদন্ত শেষে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তারেকসহ চারজনকে আসামি করে চলতি সপ্তাহে চার্জশিট দাখিল করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে এ তথ্য নিশ্চিত করে। এ ছাড়া ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন দলের এক সদস্যের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশে ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে চলতি বছরের মে মাসে যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সেই মামলায়ও তারেককে চার্জশিটভুক্ত করা হচ্ছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই মামলার তদন্তের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আসলামের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। এ মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তারেককেও চার্জশিটভুক্ত করা হচ্ছে।
সংগ্রহে ভারতে যাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। অনুমতি পাওয়া গেলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা সেখানে যাবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শুক্রবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তারেকসহ চারজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাকেসহ চারজনকে আসামি করে শিগগির চার্জশিট দাখিল করা হবে।
২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি তেজগাঁও থানায় পুলিশের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি করা হয় তারেক রহমান ও আবদুস সালামকে। ওই দু’জন ছাড়াও এজাহারে আসামি হিসেবে ‘অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর’ কথা বলা হয়। এজাহারে বলা হয়, ওই বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বছরপূর্তির আগের রাতে লন্ডনে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তারেক রহমান। তার ৫০ মিনিটের ওই বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করে একুশে টেলিভিশন। বক্তব্যে তারেক রহমান বিচার বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ নানা বিষয়ে উস্কানিমূলক কথা বলেন। তা ছাড়া নেতাকর্মীদের বর্তমান গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও আইনানুগ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। এজাহারে বলা হয়, তারেকের ওই বক্তব্যে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির ইন্ধন এবং পিলখানার ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে সরকারের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে উস্কে দেওয়ার পাঁয়তারা করা হয়। তার বক্তব্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। তারেক রহমান বিশেষ এলাকার পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ও বিভক্তি সৃষ্টি এবং বাহিনীর মধ্যে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ আনা হয়েছিল। এসব বক্তব্য অপর আসামি আবদুস সালামের যোগসাজশে একুশে টিভিতে সরাসরি প্রচার করা হয়। ওই মামলায় তদন্তে এজাহারভুক্ত দু’জনসহ চারজনের সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। তাই চার্জশিটে তারেক, সালামসহ চারজনকে আসামি করা হচ্ছে।
ডিবির এডিসি (পশ্চিম) গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে এজাহারে থাকা অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে তারেক রহমানের ওই বক্তব্য ইটিভিতে প্রচার করার পর তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশ। ওই জিডির ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে দু’দিন পর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হওয়ার দু’দিন আগে পর্নোগ্রাফি আইনের একটি মামলায় আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারেক রহমানকে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের সুযোগ করে দিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেন। ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি ওই মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। তবে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তারেক রহমান সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়ে আর দেশে ফেরেননি। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ কয়েকটি মামলায় আইনের দৃষ্টিতে পলাতক আসামি। এ জন্য তার বক্তব্য ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সব রকম মাধ্যমে প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন উচ্চ আদালত। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপরও ৫০ মিনিট ধরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেওয়া তার বক্তব্য প্রচার করা হয়। কিছুদিন আগেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয়।
এদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের এজেন্ট’ ও লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফাদির ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বৈঠকের পর সেই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। গোয়েন্দারাও নামেন তদন্তে। প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কহীন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট আসলাম চৌধুরীর যোগসূত্র। এরপরই তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আত্মগোপনে চলে যান বিএনপির ওই নেতা। তবে গত ১৫ মে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হন আসলাম চৌধুরী। পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ মে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে পুলিশ।
ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আসলাম চৌধুরীকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বাংলাদেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে মোসাদের এজেন্টের সঙ্গে ‘চুক্তিবদ্ধ’ হওয়ার কথা জানান। তার উদ্দেশ্য ছিল সরকার উৎখাত করা। ওই সূত্রের দাবি, সবকিছু দলীয় নেতা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে করেছেন। এ নিয়ে লন্ডনে বৈঠকও হয়েছিল।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ডিবি পুলিশের সূত্র জানায়, আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি দ বিধির ১২০/বি (রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র), ১২১/এ (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ষড়যন্ত্র) এবং ১২৪/এ (রাষ্ট্রদ্রোহ) ধারায় মামলাটি করা হয়েছে। গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং মামলার তদন্তে তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।