এই খালাসের রায় স্থগিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে গিয়ে প্রাথমিকভাবে কাঙ্ক্ষিত আদেশ পেলেও তা শেষ পর্যন্ত নিয়মিত বেঞ্চে টেকেনি। গত ১৭ জুলাই আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুসারে কারাগারে থাকা খালাসপ্রাপ্তদের মুক্তির বাধা কাটে।
রায় প্রকাশের মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ এখন আপিল বিভাগে আপিলের আবেদন করতে পারবেন। অনুমতি মিললে করতে পারবেন আপিলও। এরপর শেষ সুযোগ হিসাবে থাকছে পুনর্বিবেচনার আবেদন। ১১ আসামির খালাসের ঘটনায় আহসান উল্লাহ মাস্টারের পরিবারসহ এলাকাবাসী অসন্তোষ জানিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
আপিলের রায়ে হাই কোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ গত ১৫ জুন নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

তিন ফাঁসির আসামি- নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু ও শহীদুল ইসলাম শিপু
রায়ে সাতজনের সাজা কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে সেই দণ্ডই বহাল থাকে। যাবজ্জীবনের পলাতক এক আসামি আপিল না করায় তার ক্ষেত্রেও বহাল থাকে একই সাজা।নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে সাত আসামি হাই কোর্টে খালাস পান। এদের মধ্যে তিনজন পলাতক ও চারজন কারাগারে আছেন।
পলাতক তিনজন হলেন- ফয়সাল, রনি মিয়া ও খোকন। কারাগারে আছেন আমির, জাহাঙ্গীর, লোকমান ও দুলাল।
নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে হাই কোর্টে খালাস পাওয়া চারজন হলেন- রাকিব, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর ও মনির।
যার জন্য যেমন রায়
মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে ৬ জনের নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ, সোহাগ ওরফে সরু। |
৭ জনের সাজা কমে যাবজ্জীবন মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া, জাহাঙ্গীর (পলাতক), মশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম। |
যাবজ্জীবন বহাল নুরুল আমিন |
বিবেচিত হয়নি পলাতক আসামি অহিদুল ইসলাম টিপু আপিল করেননি। তার যাবজ্জীবন সাজাই বহাল। |
নিষ্পত্তি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছোট রতন ও আল আমিন মারা যাওয়ায় তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছে হাই কোর্ট। |
খালাস আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া, রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনির। |
অভিযোগপত্রে থাকা দুই আসামি কবির হোসেন ও আবু হায়দার ওরফে মিরপুরইয়া বাবু নিম্ন আদালত থেকেই খালাস পান।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, বিচারিক আদালতের নথি ও সাক্ষীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে হাই কোর্ট রায়ে বলেছে, ২০০৪ সালের ওই হত্যাকাণ্ডের মূলে ছিল মাদকের কারবার নিয়ে বিএনপির নুরুল ইসলাম সরকার এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুর রহমান মহলের মধ্যে বিরোধ। মহলসহ অনেকেই ওই হামলায় আহত হন।
আপাত দৃষ্টিতে শুধু মহলকে খুন করা হামলার উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হলেও আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যাও যে তাদের পরিকল্পনায় ছিল, তা এ মামলার বিচারে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছে আদালত।
যে স্থানে ও যেভাবে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তাকে ‘ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা মাসকিলিং’ হিসেবে বর্ণনা করে বিচারক বলেছেন, আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শকে হত্যা করা হয়েছে।
২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে খুন হন ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন।
মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে টঙ্গী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এলাকায় জনপ্রিয় আহসান উল্লাহ মাস্টার জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন।
ওই ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই বছরের ১০ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
একই বছরের ২৮ অক্টোবর ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর পর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় দেয়।
এরপর চলতি বছর ১৫ জুন হাই কোর্টের রায় আসার পর তা নিয়ে আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলসহ গাজীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সেই আবেদন শুনে গত ২১ জুন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী হাই কোর্টের খালাসের রায় স্থগিত করে বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন। পরে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে।