Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

13আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসবে মেতে উঠেছে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বনগ্রাম। গতকাল রবিবার দিনব্যাপী ব্যাপক উৎসব উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এ কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কারাম উৎসব উপলক্ষে এলাকায় ছিল সাজসাজ রব। প্রতিটি আদিবাসী বাড়িতেই এসেছিল আত্মীয়-স্বজন। শিশুরা সকাল থেকেই নতুন জামা-কাপড় পড়ে প্রস্তুত ছিল এ উৎসবকে বরণ করবার জন্য। কারাম উৎসবকে কেন্দ্র করে শুধু আদিবাসীই নয় আশপাশ এলাকার মুসলিম-হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোক সমবেত হয়েছিল বনগ্রাম মাঠে।

আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্র ও বনগ্রাম কারাম উৎসব উদযাপন কমিটি আয়োজিত এ উৎসবের উদ্বোধন করেন খাজুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ বেলাল উদ্দীন। উদ্বোধনের পর আলোচনা সভা ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত আদিবাসী সাংষ্কৃতিক দল তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। আদিবাসী নেতা নন্দলাল উড়াও এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রতন কুমার, জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সভাপতি ও চ্যানেল আই প্রতিনিধি কায়েস উদ্দীন, প্রথম সংবাদের সম্পাদক আজাদ হোসেন মুরাদ, আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দীপঙ্কর লাকড়া, সাংবাদিক গোলাম রসুল বাবু, কবি ইসমাইল হোসেন মন্ডল প্রমুখ।

জানা গেছে, আদিকাল থেকেই উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে উরাও, সাঁওতাল, পাহান, মাহ্লেসহ ৩৬টিরও বেশী গোত্রের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। মূলত এই আদিবাসীরাই প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আদিবাসীরা প্রকৃতিগত ভাবেই সহজ, সরল ও সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ। এদের বেশির ভাগেরই নিজস্ব জমি নেই। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করে চলে এদের জীবিকা। কৃষি জমিতে কঠোর পরিশ্রমের পর একটু অবসর পেলেই এরা মেতে ওঠে নানা সামাজিক উৎসবে।

সমতলের আদিবাসীরা বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কারাম, সহরাই, বাহা, ফাগুয়া, জিতিয়া ইত্যাদি। আদিবাসীরা মূলত সনাতন ধর্মের বিশ্বাসী হলেও এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের প্রকৃতি পূজারী বলেও দাবী করেন। প্রাচীনকাল থেকেই আদিবাসী সমাজে বিশ্বাস ও ধর্ম চর্চার সাথে নানা পার্বণ ও সামাজিক উৎসব জড়িয়ে আছে।

কারাম পূজা বা ডাল পূজা আদিবাসীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে কারাম পূজা করা হয় মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা ও পরিবারের মঙ্গলের জন্য। রোপা আমন লাগানোর পর অবসর সময়ে আদিবাসীরা পূজা অর্চনা ও দলবেধে নাচ-গান করে কারাম উৎসব পালন করেন। ভাদ্র মাসের চাঁদের ১০ দিন পর কারাম পূজা করা হয়ে থাকে। অনেকে আবার এই চাঁদের পূর্ণিমাতে এই উৎসব পালন করেন। আবার কেউ কেউ আশ্বিন মাসের একাদশীতে এই উৎসব পালন করে থাকেন। স্থান ও গোত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন তিথিতে এই উৎসব পালন করা হলেও কারাম পূূজার মূল আনুষ্ঠানিকা প্রায় অভিন্ন। পূজার ৬ দিন আগে থেকে কারমা দেবতার নামে গ্রামের সকল নারী-পুরুষ একত্রে ঝুমের নাচ গান করে।

কারাম পূজার প্রচলন নিয়ে এক বিশাল লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সেই প্রচলিত লোককাহিনী মতে, কারমা ও ধারমা নামের দুই ভাই ছিল। এক দিন ধারমা বললো ‘‘ভাই কারমা চল আমরা আমাদের কর্ম কপালের জন্য, সংসারের উন্নতির জন্য কারাম গোসাই এর পূজা করি। কিন্তু কারমা সে কথা অবজ্ঞা করে চলে গেল। ধারমা তখন একাই কারাম গোসাইয়ের পূজার আয়োজন করলো। বোনদের দাওয়াত করলো, বোনরা এসে উপবাস থেকে জাওয়া জাগাতে (বিভিন্ন ধরনের রবিশস্যের ধান গজাতে) আরম্ভ করলো। এমন সময় কারমা এসে জাওয়া জাগানো ডালিটি ফেলে দিল এবং পূজার সমস্ত আয়োজন লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে বললো এখানে কোন কারাম গোসাইয়ের পূজা হবে না। এর পর কারমার কপালে নেমে এলো চরম দুর্দশা । খাবার গেলে ভাতের দানা হারিয়ে যায়, মাঠে গেলে শস্য থাকে না এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায় কারমা।

তার এ দুর্ভাগ্য জানার জন্য এক পন্ডিতের কাছে গেল কারমা। পন্ডিত সব শুনে বললো কারাম গোসাইকে অবহেলা ও অপমান করার জন্যই তার এ হাল হয়েছে। এ কথা শোনার পর কারমা অনুতপ্ত হয় এবং নিজের ভূল বুঝতে পেরে কারাম গোসাইয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তার পূজা অর্চনা করে। এ পূজা অর্চনার মধ্য দিয়ে কারমা তার কর্ম কপাল পুনরায় ফিরিয়ে আনে। আর এই কারমার নাম অনুসারে এই উৎসবকে কারমা বা কারাম উৎসব বলা হয়। সেই থেকে আদিবাসীরা নিজের কর্মকপাল নিয়ে সুখে থাকার প্রত্যয়ে কারাম উৎসব পালন করে আসছে। আগে এ উৎসবটি আদিবাসীরা নিজেদের মত করে পারিবারিক ভাবে পালন করলেও গত কয়েক দশক থেকে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সহযোগীতায় বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানে আদিবাসী ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন শেণী-পেশার মানুষ যোগ দিচ্ছেন । তাদের স্বর্তফুত অংশগ্রহণে আরো মজবুত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অছেদ্য বন্ধন ।