আর্থিক খাত পরিচালনায় ও নীতিনির্ধারণে শিক্ষকতা পেশা থেকে আসা ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য ছিল একসময়। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানা কেলেঙ্কারি ও ব্যাংকিং খাতের অবনমনের ঘটনায় সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক বা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কিংবা প্রধানের পদে শিক্ষকদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন আমলারা। রাষ্ট্রায়ত্ত তিন বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানও এখন সাবেক আমলা।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। ২০০১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। ২০০৩ সালে এ পদে আসেন অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. এএইচএম হাবিবুর রহমান। এর পর শিক্ষকতা থেকে আসা কেউ আর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাননি। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আশরাফুল মকবুল।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়ের প্রখর বামপন্থী চিন্তাবিদ ড. আতিউর রহমান ও ড. আবুল বারকাতের মতো অধ্যাপকরা। ২০১৪ সালে অধ্যাপক আবুল বারকাতের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর শিক্ষকতা পেশার আর কাউকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। বর্তমানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক। তার মেয়াদ শেষে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বি আইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখ্ত।
একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করছেন একজন সাবেক আমলা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালকের পদ শূন্য থাকলেও এসব পদে শিক্ষকতা পেশার কাউকে আর ভাবছে না সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে আর্থিক খাতে অনাকাক্সিক্ষত নানা পরিস্থিতির কারণে অধ্যাপকদের চেয়ে আমলা ও পেশাজীবীদেরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে পেশাজীবী ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন মানুষদের নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে জনগণের সঙ্গে আমলাদের একটু দূরত্ব রয়েছে। তাই এসব পদে যোগ্য লোক বাছাইয়ে বিকল্প চিন্তা করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে অধ্যাপক নাকি আমলারা নিয়োগ পাবেন, সে বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সঠিক কোনো নীতিমালা ছাড়াই এসব পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তদের অবশ্যই অর্থনীতির ব্যাকগ্রাউন্ডের হতে হবে। পাশাপাশি তাদের সততা ও সুনামের বিষয়টিও দেখতে হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে রাজনৈতিক মানসিকতার ক্ষেত্রে স্বাধীনচেতাদের বিবেচনার বিষয়টিতে। চেয়ারম্যান পদে অধ্যাপকের স্থলে আমলারা এলেও এসব গুণাবলি যদি না থাকে, তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক অধ্যাপক ড. এএইচএম হাবিবুর রহমানকে। প্রত্যাশা ছিল, তার নেতৃত্বে ব্যাংকটি নাজুক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসবে। তিন বছরের মতো দায়িত্ব পালন করলেও পরিস্থিতি উত্তরণে খুব বেশি সাফল্য দেখাতে পারেননি তিনি। বড় অংকের ঋণ অবলোপন করা হয় এ সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল বারকাত ২০০৯ সালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার সময় জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। তিন বছর পর ২০১২ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩২০ কোটি টাকায়। ২০১৪ সালে চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ রেখে যান ৩ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত জনতা ব্যাংককে ২০১২ সালে ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়।
২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক। এ অধ্যাপক দায়িত্ব নেয়ার আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকায়। ২০১৪ সালে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকায় রেখে অগ্রণী ব্যাংক থেকে বিদায় নেন তিনি। ড. খন্দকার বজলুল হকের দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে ১ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ছয় বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন ড. আতিউর রহমান। দায়িত্ব পালনকালে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও গ্রিন ব্যাংকিংয়ের মতো বেশকিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। তবে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ রিজার্ভ চুরির ঘটনার মধ্য দিয়ে গত ১৫ মার্চ গভর্নর পদ থেকে বিদায় নিতে হয় তাকে। নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ফজলে কবিরকে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মাহ্বুব উল্লাহ্ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোয় গত কয়েক বছরে যা ঘটেছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটলেও এটি নিয়ে আইনপ্রণেতা (সংসদ সদস্য) ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে তেমন আলোচনা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে এক ধরনের গড়িমসির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।
দায়িত্বের বিষয়ে আমলা নাকি অধ্যাপক— এ বিষয়ে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে যোগ্যতা নির্ধারণ হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে। ফলে দায়িত্ব পাওয়ার পর সেটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনিক ও দায়িত্বের প্রতি অবহেলা দেখা যায়। এক্ষেত্রে যতই সময় যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই জটিল হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২৫টির বেশি পরিচালক পদ শূন্য রয়েছে। চলতি ও আগামী বছর খালি হবে আরো ১৫টির বেশি পরিচালক পদ। শূন্য থাকলেও শিক্ষকতা পেশা থেকে ব্যক্তিদের বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না এক্ষেত্রে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা ও সুশাসনের ঘাটতি দূর করতে দায়িত্বশীল যে কাউকে পদায়ন করা যেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্স সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থপ্রবাহে এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই যারাই দায়িত্ব নিক না কেন, তাদের অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের মানের কোনো উন্নতি হচ্ছে কিনা, মানসম্মতভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে কিনা, সে বিষয়গুলো দেখতে হবে। বণিকবার্তা