খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬:
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য নেওয়া হয়নি। ১৫ ডিসেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন আদালত। পুরো সময়ে খালেদা জিয়ার পক্ষের আইনজীবী ও বিচারকের মধ্যে দীর্ঘ বাক্যবিনিময় হয়।
খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুর রেজাক খান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রমুখ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল।
আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রমুখ।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে খালেদা জিয়ার মামলা কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় খালেদা জিয়া আদালতের সামনে বাঁ পাশে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন।
বিচারক আবু আহমেদ জমাদারের আদালতে শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতকে বলেন, ‘এ মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেওয়ার আগে আইন অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করেননি। সুপ্রিম কোর্টের একটি প্রজ্ঞাপন রয়েছে, সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণ করে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করবেন। অর্থাৎ মুসলমান হলে আল্লাহ, হিন্দু হলে তাঁদের দেবী আর খ্রিস্টান হলে গডের নামে সাক্ষীরা সাক্ষ্য প্রদানকালে সাক্ষ্য দেবেন।’
‘কিন্তু এ মামলায় ৩২ জন সাক্ষী সুপ্রিম কোর্টের এই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের একটি আবেদন হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে হয়তো যেসব সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো বাতিল করে নতুন করে সাক্ষ্য নেওয়া হতে পারে।’
মাহবুব হোসেন আরো বলেন, ‘মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আজ আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই আদালতের কাছে আবেদন, হাইকোর্টে এ মামলার নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত এ মামলার বিচার কার্যক্রম মুলতবি করা হোক।’
এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘যেহেতু হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার আবেদনের ওপর কোনো স্থগিতাদেশ দেননি, তাই এ মামলার কার্যক্রম চালাতে কোনো বাধা নেই। ইতোপূর্বেও তাঁরা (খালেদা জিয়ার আইনজীবী) বহু আবেদন করেছেন। কোনো আবেদনে তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে মামলা কার্যক্রম স্থগিত করতে আদেশ পাননি; বরং এত ছোটখাটো আবেদন তাঁরা করেন, যা দেখে উচ্চ আদালত আশ্চর্য হয়েছে এবং এ মামলা কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। মামলা কার্যক্রমে সময়ক্ষেপণের জন্য তাঁরা আবেদনগুলো করে যাচ্ছে।’
ওই বক্তব্যর বিরোধিতা করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, অনেক মামলা রয়েছে, যেগুলো দুই যুগ ধরে স্থগিত রয়েছে। দুদকের এসব মামলা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
এরপর খালেদা জিয়ার উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘যেহেতু মামলার কার্যক্রমে উচ্চ আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ নেই, তাই আপনি আপনার আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য শুরু করেন।
ওই সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কিছুটা হৈচৈ শুরু করেন। পরে সিনিয়র আইনজীবীরা তাঁদের শান্ত করেন। পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছি। এটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচারকাজ চালানো ঠিক হবে না। আপনি যদি ক্ষমতার জোরে বিচার শুরু করেন, তাহলে আমরা আইনজীবীরা সবাই আদালত থেকে বের হয়ে যাব। আমরা আপনার প্রতি আস্থা রাখি। আপনি জোর করে মামলা কার্যক্রম চালাতে পারেন না।’
জবাবে বিচারক বলেন, ‘আদালতের সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া অধিকাংশ সময় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে আদালতে হাজির হয়েছেন। আমি চেষ্টা করেছি, উনাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমি চাইলে অনেক বিষয়ে আরো কঠোর হতে পারতাম।’
‘কিন্তু ম্যাডাম খালেদা জিয়া সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী। তাই উনাকে আমি সম্মান দিচ্ছি।’
জবাবে মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, ‘এই জন্য আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে তো আইনি বিষয় থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’
এর পর খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মাই লর্ড, আমরা আপনাকে সম্মান করি। আপনার প্রতি আস্থা রাখি। আপনি যদি এ সময়ে মামলা কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তাহলে আমরা মনে করব আপনি অতি উৎসাহী হয়ে মামলা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এতে করে আপনার মামলা কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি ঘোষণা করা হোক।’
এর পর খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘খালেদা জিয়া এ দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বিচার যেন ন্যায়বিচার হয়, সময় চাচ্ছি। আমরা হাইকোর্টে যে আবেদন করেছি, তা এ মুহূর্তে প্রধান বিচারপতির নিকট রয়েছে। আমরা আশা করি, এ সপ্তাহের মধ্যে ওই আবেদনের নিষ্পত্তি হবে। হাইকোর্ট আর মাত্র পাঁচ দিন খোলা থাকবে। এ সময়ের মধ্যে আশা করি ওই আবেদন নিষ্পত্তি হবে। তাই পাঁচ দিন আমাদের সময় দেন।’
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমার সামনে প্রথিতযশা আইনজীবীরা শুনানি করছেন, যাঁদের দেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত সবাই চেনেন। আর বিচারও হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর। আমি নিজেও বিচারিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। আমি কারো বক্তব্য শুনে বিচার করি না; বরং ন্যায়বিচারের স্বার্থে কাজ করে থাকি। তাই ম্যাডাম বেগম খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ বক্তব্য শুনানির জন্য আরো এক সপ্তাহ সময় দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর দিন ধার্য করলাম।’
এ পর্যায়ে আইনজীবীদের বক্তব্য শেষে আদালত খালেদা জিয়ার পক্ষে সময় আবেদন মঞ্জুর করে আগামী এক সপ্তাহ এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদার।
এর আগে আজ সকালে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদারের অস্থায়ী আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে অসমাপ্ত বক্তব্য প্রদান করতে হাজির হন খালেদা জিয়া। ১ ডিসেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য শুরু করেন তিনি। সেদিন তিনি আংশিক বক্তব্য দেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।
জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।
ওই মামলার অপর আসামিরা হলেন—খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বি আইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।