খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭: পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছে শিশুরা। ধর্ষণের সময় ধারণ করা ভিডিও বা বিভিন্ন অশ্লীল স্থিরচিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া-সংক্রান্ত ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন থাকলেও এর ব্যবহার তেমন একটা হচ্ছে না।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় মামলা হলে মামলা পরিচালনা সহজ হয়। ভুক্তভোগীর সুবিচার পাওয়া নিশ্চিত করা যায়।
গত মে মাসে ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানায় মেয়ের নগ্ন ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় একটি মামলা করেন এক স্কুলছাত্রীর বাবা। গোয়েন্দা বিভাগে স্থানান্তর হওয়া এ মামলা প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের গোয়েন্দা বিভাগের ওসি আশিকুর রহমান বলেন, মাঠপর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের (২০১৩ সালে সংশোধিত) ৫৭ ধারাটি সম্পর্কে আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ওয়াকিবহাল হলেও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি নিয়ে ততটা ওয়াকিবহাল নন। পর্নোগ্রাফি-সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা ৫৭ ধারায় করা হচ্ছে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, কোনো শিশুকে ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিতরণ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অথবা শিশু পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, সরবরাহ বা প্রদর্শন অথবা কোনো শিশু পর্নোগ্রাফি বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তার সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হবে।
অন্যদিকে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে অথবা এর মাধ্যমে মানহানি ঘটে…। এ অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়কারী আবদুল্লা আল মামুন বলেন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি সুনির্দিষ্ট একটি আইন। এ আইনের অধীনে একটি-দুটি মামলায় দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ার নজির থাকলে অপরাধীরা ভয় পেত।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পর্নোগ্রাফির শিকার শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, (১০টি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য), গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১২ জন শিশু পর্নোগ্রাফির শিকার হয়। আর চলতি বছরের এই একই সময়ে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ২০ জনে। অর্থাৎ এই সময়ে এ ধরনের অপরাধ বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
আটটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ এবং মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নিজস্ব পর্যালোচনা অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্নোগ্রাফির শিকার শিশুদের ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে ১০টি। তবে এ ১০টি মামলা পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে হয়েছে কি না, সে তথ্য নেই সংস্থাটির কাছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আইনটির আওতায় ১৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। চলমান মামলার সংখ্যা ১৩। তবে এসব মামলার মধ্যে কতটি শিশু পর্নোগ্রাফি-সংক্রান্ত সে তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম জানালেন, গত এক বছরের মধ্যে শিশুরা পর্নোগ্রাফির শিকার হওয়া-সংক্রান্ত কোনো মামলা হয়নি।
রাজধানীর ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পর্নোগ্রাফির শিকার শিশুর অভিভাবকেরা অভিযোগ নিয়ে আসেন, তবে পরিবারের মানসম্মান এবং মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত মামলা করতে চান না।
৪ অক্টোবর পিরোজপুরে চার স্কুলছাত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিজিৎ রাহুল ব্যাপারী (২৭) নামে এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী এক ছাত্রীর বাবা মামলা করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলায় পুলিশ অভিজিৎকে গ্রেপ্তার করেছে।
মামলার বাদী এক ছাত্রীর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটি প্রথম ঘটেছিল ২০১৪ সালে। তখন ঘটনা চাপা দিয়ে রাখি ও অভিজিতের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হই। কিন্তু এবার আবার মেয়ের ছবিসহ চার মেয়ের ছবি ছড়িয়ে গেছে ফেসবুকে। আমার মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে অভিজিৎ ছবি তুলেছে এবং সেই ছবি ফেসবুকে ছেড়ে আমার মানসম্মান সব নষ্ট করে দিয়েছে।’
অবশ্য অভিজিতের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিরোজপুর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাচনাইন পারভেজ বলছেন, এ মামলায় পর্নোগ্রাফির কিছু পাওয়া যায়নি। তাঁর মতে, যে ছবিগুলো প্রকাশ পেয়েছে তাতে মেয়েদের মুখ দেখা যাচ্ছে। পেছন দিকে জড়িয়ে ধরে আছে এ ধরনের ছবি। এটি অশ্লীল ছবি না।
তবে সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (ইকোনমিক ক্রাইম ও সাইবার ক্রাইম) মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি শক্তিশালী আইন। পর্নোগ্রাফির মামলা বিশেষ করে শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক।