খােলা বাজার২৪। মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায়ের দিনকে ঘিরে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপি। খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার রায়ের এ দিনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে রাজপথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেয়ার প্রস্তুতি রাখছে বিএনপি। তাদের ভাষায়, ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ‘অন্যায়ভাবে’ কিছু করা হলে ঢাকাসহ সারাদেশে যে যেখানে থাকবে সেখান থেকেই প্রতিবাদ করার জন্য রাস্তায় নেমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করা হবে। তবে রায় নিয়ে সরকারের কোনো উসকানির ফাঁদে পা দেবে না দলটি। অপরদিকে আওয়ামী লীগও রাজধানীসহ সারা দেশের রাজপথ নিজেদের দখলে রাখবে, যদিও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ওই দিন তাদের পার্টির কোনো কর্মসূচি নেই। কোনো ধরনের কর্মসূচি না রাখারই নির্দেশ দিয়েছেন তাদের দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে তিনি এও জানিয়েছেন যে, রায়কে কেন্দ্র করে কেউ যদি পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সতর্ক পাহারা থাকবে তাদের।
রায়কে ঘিরে দুই দলের এই পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতিতে শঙ্কা তৈরি হয়েছে জনমনে, কী হতে যাচ্ছে ৮ ফেব্রুয়ারি! দেশের এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে হানাহানি-সংঘর্ষ বাধার সম্ভাবনা রয়েছে? ওই দিন রায়কে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিহত করতে প্রস্তুতি রাখছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিটি থানাকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে অতীতে যারা সন্ত্রাসে জড়িত ছিলেন তাদের রাখা হয়েছে নজরদারিতে। যেসব নেতাকে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি মনে করা হবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করবে ঢাকার পঞ্চম জজ আদালত। বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের ওই মামলার প্রধান আসামি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার অযোগ্য হয়ে পড়বেন।
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানও এ মামলার আসামি। মুদ্রা পাচারের দায়ে সাত বছর কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। এ মামলাতেও তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। প্রথম থেকেই বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ‘অন্তঃসারশূন্য’ এই মামলাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে কেবল খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য।
বিএনপি: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীসহ সারাদেশে রাজপথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেবে বিএনপি। এর আগের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) সংবাদ সম্মেলন করবেন দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। ওই সংবাদ সম্মেলনেই জাতির কাছে বক্তব্য তুলে ধরবেন তিনি। রায় নিয়ে সরকারের কোনো উসকানিতে পা দেবে না দলটি। রায় যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
রোববার রাতে গুলশানে দলীয় চেয়ারপার্সনের অফিসে দলের স্থায়ী কমিটির সভা হয়, তাতেই এসব সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে সংসদের বাইরে আসা বিএনপি মনে করে, খালেদা জিয়ায় দুর্নীতি মামলায় রায়কে সামনে রেখে আবার নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে তারা। দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের এই মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়ার শাস্তি হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে দলটির নেতাদের। এই রায় ঘোষণার তারিখ ঠিক হওয়ার পর দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারবাহিক বৈঠকে বসেছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু কোনো কর্মসূচির ঘোষণা দেননি তিনি। জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করেছেন তিনি। সেখানে তৃণমূল নেতারা বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছেন। স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক ও নির্বাহী কমিটির সভায় তৃণমূল নেতাদের এসব মতামত নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শনিবার রাজধানীর লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির ওই বৈঠকে ৮ ফেব্রুয়ারি রায় নিয়ে উদ্বিগ্ন তৃণমূলের নেতারা কর্মসূচি চেয়েছেন। তারা তাদের চেয়ারপার্সনের সাজা হলে স্বেচ্ছা কারাবরণসহ নানা কর্মসূচির প্রস্তাব রাখেন। দাবি তোলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা যেন মাঠে সক্রিয় হন।
নাম প্রকাশ করা হবে না- এমন শর্তে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) অন্যায়ভাবে কিছু করা হলে ঢাকাসহ সারাদেশে যে যেখানে থাকবে সেখান থেকেই প্রতিবাদ করার জন্য হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করা হবে। আমাদের দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে। বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।
তিনি আরো বলেন, সমস্ত জেলায় যার যার এলাকায় নেতাকর্মীরা রাজপথে অবস্থান নেবে। শুধু ৮ ফেব্রুয়ারি নয়, এখন থেকে নিয়মিত মাঠে থাকবে তারা।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, বিএনপির কৌশল হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দলের শক্তি অক্ষুণœ রাখা। তাই ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক রায়’ হলেও সহিংস প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে দলটি নির্বাচন পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়। শনিবার নির্বাহী কমিটির যে সভা হয় তাতে বিএনপির চেয়ারপার্সন দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে সরকারের ফাঁদে পা না দেয়া, সহিংসতায় না জড়ানো, কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিতে নেতাকর্মীদের কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন।
আওয়ামী লীগ: বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের দিন রাজধানীসহ সারা দেশের রাজপথ নিজেদের দখলে রাখবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই দিন আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি না থাকলেও মহানগর, জেলা, উপজেলা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় ও অলিতে গলিতে সতর্ক অবস্থান নেবে দলটির নেতাকর্মীরা। এ লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে তৃণমূলে এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ১৪ দলের শরিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমমনা শক্তিগুলোকেও ওইদিন মাঠে নামাবে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ও দলীয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমাদের পার্টির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ তারিখে আমাদের কোনো কর্মসূচি রাখতে বলেননি। ওই দিন আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই, দেবও না। তবে রায়কে কেন্দ্র করে কেউ যদি পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে তা হলে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সতর্ক পাহারায় থাকব। নেতাকর্মীদের কোনো উসকানিতে পা না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের জানমাল নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে। কোন পরিস্থিতিতে কখন কী করতে হবে সেটা তারা দেখবে।
এদিকে নির্বাচনের বছরে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্য ঠেকাতে দলের তৃণমূলকে নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শনিবার থেকে ডাকযোগে সাংগঠনিক জেলা ও উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কাছে এসব নির্দেশনা উল্লেখ করে চিঠি পাঠানো শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা না হলেও আগামী নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলকে সতর্ক করা হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখিত চার দফা নির্দেশনার প্রথমটিতে বলা হয়েছে; সংবিধান ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। একই চিঠিতে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হবে, সে পরামর্শও রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, ৮ তারিখে প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদের নেতাকর্মীরাও সতর্ক অবস্থান নেবেন। কেউ নাশকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করবে। ইতোমধ্যে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৬ ফেব্রুয়ারি (আজ) প্রস্তুতি সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
রায়কে ঘিরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রস্তুতি: এদিকে রায়কে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিহত করতে প্রস্তুতি নিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিটি থানাকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে অতীতে যারা আগুন সন্ত্রাসে জড়িত ছিলেন তাদের রাখা হয়েছে নজরদারিতে। যেসব নেতাকে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি মনে করা হবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। যখনই বিএনপি আন্দোলনের জন্য মাঠে নামবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে পুলিশের গাড়িতে হামলার ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ বেশ কয়েক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রোববার গুলশানে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ৮ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে সব ধরনের নৈরাজ্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত আছে। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে আর কোনো নাশকতা ও নৈরাজ্য হতে দেবে না। যদি কেউ কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তাহলে এদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে। মানবকণ্ঠ