খােলাবাজার২৪,বৃহস্পতিবার,০৫মার্চ,২০২০ঃ দিনের ঢাকা। কর্মব্যস্ত। প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হয় না। কিংবা একই ছাদের নিচে থেকেও সময় দেওয়া হয় না প্রিয়জনকে। এবার মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতে পারবেন আপনিও
কয়েক বছর আগের কথা। গুলশানের এক ক্যাফেতে আমার এক বন্ধুযুগল কফি খেতে গেছে। ঢাকা শহরে আগে কফি খাওয়ার খুব একটা প্রচলন ছিল না। বাইরে কোথাও বসা যায়- এই কনসেপ্টাও এই দেশে গত কয়েক বছরের। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে রাতজাগা কালচার। রাত জেগে পার্টি, আড্ডা, আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের বাসায় গিয়ে হ্যাং আউট করা। আর সে কারণে প্রায়ই দেখি, রাত ১২টা কিংবা আরও পরে মানুষ রেস্টুরেন্ট কিংবা কফিশপ থেকে ফেসবুকে চেক ইন করছে, ছবি পোস্ট করছে। একদিন কাছের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তোমরা যে এত রাতে বাইরে খেতে যাও পরের দিন অফিসের কাজে সমস্যা হয় না? সে উত্তর দিল, ঢাকা শহরে খাওয়া ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। মানুষ করবে কী! যেহেতু মানুষের আর কিছু করার নেই, তাই গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে খেতে যাওয়ার কালচারটা শুরু হয়েছে। যেহেতু এখন মানুষ খেতে ভালোবাসে, তাই তৈরি হয়েছে অসংখ্য ক্যাফে। এসব ক্যাফেতে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাই হওয়ার কথা। এরা বন্ধুদের বাসায় না এনে, ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিতে পছন্দ করে। পরিবারগুলোও ঝামেলামুক্ত থাকে।
দুই
ঢাকা। জাদুর এক শহর। চারদিকে কোলাহল। মানুষ আর মানুষ। মুখরিত নগরী। প্রতি মুহূর্তে ঢাকায় পা দিচ্ছে অন্যান্য শহর বা গ্রাম থেকে আসা অসংখ্য মানুষ। বুড়িগঙ্গা তীরের ৩০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষের চাপ। সঙ্গে থাকে সড়কে তীব্র যানজট। দিনের কর্মব্যস্ত আমাদের এই প্রিয় শহর, পুরোপুরি যেন পাল্টে যায় রাতে। দিন ও রাতে অভিন্ন ঢাকা ধারণ করে ভিন্ন রূপ। শহরের রাতের রূপটি আকৃষ্ট করে অনেককেই। একইভাবে সুবিধাবঞ্চিতদের রাত্রিযাপন কষ্টও দেয় অনেককেই। সব মিলিয়ে যেন জাদুর শহর এই ঢাকা। রাত ১১টার পর থেকেই রাস্তা ফাঁকা হতে থাকে। থেমে যেতে থাকে ব্যস্ত নগরীর কোলাহল। কোনো কোনো অলিগলিতে ভর করে নির্জনতা। সড়কজুড়ে তখন লাল, নীল আলোর খেলা। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আলো ছড়িয়ে দেয় লাইটপোস্টগুলো। এই রাতের শহরে প্রতিনিয়ত আড্ডা জমে অভিজাত এলাকার ক্যাফেগুলোতে। সাধারণত রাতের আড্ডায় বন্ধুবান্ধবী ও প্রেমিক-প্রেমিকাদের অংশগ্রহণই বেশি থাকে। ক্যাফেগুলোর আধো আলো-আঁধারে বসে গল্প করেন তারা। অভিজাত এলাকার ক্যাফেগুলোতে দিনের চেয়ে রাতেই যেন ব্যস্ততা বেশি। বিশেষ করে রাত ১০টার পর থেকে যেন এগুলো জমে ওঠে।
চার
চলুন জেনে নিই ঢাকার ক্যাফেগুলো সম্পর্কে
- বারিস্তা লাভাজ্জা
ইতালিয়ান কফিশপ লাভাজ্জায় পাবেন আন্তর্জাতিক মানের সব কফি। ভিন্ন ধরনের স্বাদ দিতে তাজা বিনেই কফিগুলো লাইভ তৈরি করে দেবে। এসপ্রেসো, কাপুচিনো, লাটে, মোকা কফিগুলো রেগুলার হলেও স্বাদে রয়েছে ভিন্নতা। এ ছাড়া কফির পাশাপাশি মাফিম, ভিন্ন ধরনের স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রিসহ পাবেন নানা রকম আইটেম। ছিমছাম সাজানো শপটির হলুদ আলোয় আপনাকে দেবে নীরবতার ছোঁয়া। তাদের শপটির শাখা রয়েছে গুলশান অ্যাভিনিউ, উত্তরা, বিমানবন্দর, কারওয়ান বাজারে। তাদের কফি উপভোগ করতে পারবেন সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।
- বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা
আসল কফির স্বাদ নিয়ে গত বছরই যাত্রা শুরু হয়েছে এই শপটির। কফির সবুজ ফল থেকে রোস্টিংয়ের মাধ্যমে কফি বিন তৈরি করা হয়। তারপর এটাকে তিন সপ্তাহের বেশি ব্যবহার করা হয় না। তাই তাদের মতে, কেউ তাজা বা আসল কফির স্বাদ পেতে চাইলে এখানেই আসতে হবে।’ কারণ রোস্ট বিনটি তাজা থাকে তিন সপ্তাহ। কিন্তু অন্য কফি শপগুলো তা ব্যবহার করে বছরের পর বছর। জানা যায়, এই ক্যাফেতে শুধু ব্রাজিলে উৎপাদিত কফি ব্যবহূত হয়। তারা বিশেষভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে কফি রোস্টিং করে, আর তা ব্যবহার করা হয় তিন সপ্তাহের মধ্যে। তাদের ভাষ্য, এই সময়ের মধ্যে রোস্টেড বিনস থেকে কফি বানালে এর স্বাদ থাকে অটুট। এরপর থেকেই নাকি ধীরে ধীরে স্বাদে ভাটা পড়তে থাকে। এখানে পাবেন এসপ্রেসো, ক্যাপুচ্চিনো আর মোকা। সঙ্গে পাবেন মজাদার স্বাদের কিছু খাবার। যার মধ্যে স্মোকড চিকেন স্যান্ডউইচ, রোল, লাঞ্চ বা ডিনার আইটেম। শপটি খোলা থাকে সকাল ১১টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।
- গ্লোরিয়া জিন’স কফি
এই কফিশপে ঢুকতেই নাকে আসবে কফির মাতাল করা ফ্লেবার। আর ভেতরে ঢোকার পর চোখ এড়িয়ে যাবে না আরামদায়ক বসার ব্যবস্থাও। ছোট টেবিলের পাশাপাশি বড় টেবিলও রয়েছে। যেখানে বন্ধু বা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে কফির স্বাদ নিতে পারবেন। শপের পেছনের অংশে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে কফির স্বাদ উপভোগ করার ব্যবস্থা রয়েছে। সবুজ পরিবেশ আর বিশ্বখ্যাত বোস সাউন্ড সিস্টেমে সংগীত উপভোগ করতে পারবেন। শপটি প্রতিদিন খোলা থাকে সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত।
- ব্রোনিয়া ক্যাফে অ্যান্ড গ্যালারি
কফি আর চিত্রকর্ম- একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা প্রথম ক্যাফে হতে পারে এটি। দেয়ালজুড়েই আছে নানা ধরনের চিত্রকর্ম। জানা গেছে, এক চিত্রশিল্পী এখানে প্রায়ই অতিথিদের জন্য ‘পোর্ট্রেট’ করেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিনস দিয়ে বানানো হয় এখানকার কফি। এখন ব্যবহার করা হচ্ছে স্টারবাকসের কয়েকটি রোস্টিং। ক্যাপুচিনোর কাপের গন্ধের সঙ্গে কফি আর্টও মন্দ মিলবে না এখানে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ক্যাফের পাশের একটি কক্ষে একেবারেই বিনা খরচায় সিনেমা দেখারও বন্দোবস্ত রয়েছে। এর মধ্যে এক দিন আবার বরাদ্দ রাখা হয় শিশুদের নিয়ে সিনেমা দেখার জন্য। সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
- কিভা হান
পৃথিবীর প্রাচীনতম কফিশপের নাম থেকে এই নাম এসেছে। যে দোকানের শুরু হয়েছিল ১৪৭৫ সালে। গুলশানে শপটির যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে। কফির সঙ্গে মোক্ষম পরিবেশ দিতে সাজিয়ে তোলা হয়েছে শপটি। এই কফি তৈরি করা হয় একটু ভিন্ন স্টাইলে। ফলে আপনি পাবেন কফির তাজা স্বাদ। আর কফির সঙ্গে আপনি যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটাতে পারেন। তার জন্য বাধা-নিষেধ নেই। শপটি খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত।
- ব্রিজ অ্যান্ড বাইটস
ঢাকার কফি জগতের অন্যতম সংযোজন ব্রিজ অ্যান্ড বাইটস। এখানে কফি বানানো হয় শুধু বিশ্বখ্যাত ইলি কফি বিনস দিয়ে। ইতালি থেকে বাজারজাত হওয়া এই কফি বিক্রি হয় প্রায় ১৪০টিরও বেশি দেশে! ইলি কফির বাংলাদেশে যারা বিপণন করে থাকেন, তারাই কিন্তু খুলেছেন এই ক্যাফে! আর তাই স্বাদ বা গন্ধ নিয়ে বোধ হয় থাকছে না কোনো সংশয়! হট ও কোল্ড মিলে ১৬টি ভিন্ন স্বাদের কফি মিলছে এখানে।
- নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স
নর্থ এন্ডের কফির মাতাল করা ঘ্রাণ টের পাবেন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ই। দরজা খুললেই মনে হবে হারিয়ে গেছেন কফির রাজ্যে! চোখে পড়বে কাউন্টারের পেছনে থরে থরে সাজানো আমদানি করা কফির বস্তা। ব্রাজিল, কোস্টারিকা, ইথিওপিয়া, গুয়েতেমালা, ইন্দোনেশিয়া এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের কফি। রেস্তোরাঁজুড়েই চোখে পড়ে কফির আবহ। হোটেল লেক শোরেও তাদের শাখা আছে। শনি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে সাড়ে রাত ১২টা পর্যন্ত।
শুধু এগুলোয় নয়, ঢাকা শহরের রাত মানে কারওয়ান বাজার, সোয়ারীঘাট, সদরঘাট, সায়েদাবাদ, টিকাটুলী মোড়, গুলিস্তান, কমলাপুর, মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়, ফকিরাপুল, শাহবাগ, মালিবাগ, মগবাজার মোড়, ফার্মগেট, মহাখালী, গাবতলী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চানখাঁরপুল, পলাশীর মোড়, টিএসসি কিংবা বাংলামটর। পেশাজীবী মানুষ মানেই শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে নিদেনপক্ষে এক কাপ চা খেয়েছেন। এদিকটা তাই গভীর রাত পর্যন্ত থাকে ব্যস্ততায় মোড়া। এই জায়গাগুলোতেও শত শত মানুষ ভিড় করে। ঝালমুড়ি, চিড়া-দই, চা-সিগারেট কিংবা সেদ্ধ ডিম খেতে খেতে আড্ডা চলে রাত ২টা পর্যন্ত। সময় এখানে জীবন্ত। অন্ধকার এখানে আলোরই অপর নাম।
রাতের ঢাকার নানা বৈচিত্র্য দেখার সুযোগ মেলে না সবার। বোহেমিয়ান জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষও গভীর রাতে নিরাপত্তাহীনতায় ঘরে ফেরে। তবু রাজপথেই কিছু মানুষের সাজানো সংসার। উদ্বাস্তু সময়ের সুখ-দুঃখ নিয়েই টানাপোড়েনের জীবন তাদের। সোডিয়ামের আলোয় যে জীবন হলদেটে, ফ্যাকাশে। আবার অভিজাতপাড়ায় রাত নামলেই মেলে আনন্দের সব রং। রাত সেখানে কাঙ্ক্ষিত সুন্দর। রাতের এমন বহুরূপী ঢাকা দেখার সুযোগ যাদের হয়নি, তাদের সত্যিই অজানা থেকে যাবে জীবনের অনেক কিছুই।