Fri. May 16th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

বিশেষ প্রতিনিধি: শতবর্ষ প্রাচীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে অত্যন্ত গোপনে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রত্যাশিত সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনকে অজ্ঞাত রেখে। অথচ সরকার সামগ্রিক সংস্কার কার্যক্রম একটি কাঠামোবদ্ধ (systematic) প্রক্রিয়ায় শুরু করেছিল। প্রথমে খাতভিত্তিক কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়; কমিশনসমূহ তাদের প্রতিবেদন প্রদান করে। পরবর্তীতে এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য একটি ‘ঐক্যমত কমিশন’ গঠিত হয়, যারা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার একটি পৃথক পরামর্শক কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তাদের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়নি, প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়নি। এরপর, হঠাৎ করেই মধ্যরাতে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

এ অবস্থায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তি এবং সার্বিক রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার ইস্যুতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের বক্তব্য নিম্নরূপ:

বর্তমানে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ৮৬ শতাংশই এনবিআরের মাধ্যমে আহরিত হয়, যা জাতীয় উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশে সরাসরি অবদান রাখে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় এই পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩,৮২,৬৭৮ কোটি টাকায়। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে রাজস্ব আহরণের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৬.৪৪ শতাংশ, যা যেকোনো রাজস্ব কর্তৃপক্ষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই অর্জন প্রমাণ করে যে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এনবিআর তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭৬ নম্বর আদেশ (National Board of Revenue Order, 1972) মূলে গঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এ পর্যন্ত ৫৩ বছরে মোট ৩১ জন চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন। আদেশ মোতাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিনিয়রমোস্ট সদস্য চেয়ারম্যান হিসেবে পদায়নের কথা লেখা থাকা সত্ত্বেও বিগত সময়ের প্রায় সব চেয়ারম্যানই এসেছেন কাস্টমস ও কর ক্যাডারের বাইরে থেকে। প্রত্যেক চেয়ারম্যানের গড় মেয়াদ মাত্র ১.৭ বছর। চেয়ারম্যানদের স্বল্প মেয়াদ এবং আয়কর আইন, কাস্টমস আইন, ভ্যাট আইন ব্যবস্থাপনায় বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে হ্রাস করেছে।

১৯৭৯ সালে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ গঠিত হওয়ার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে উক্ত বিভাগের রাজস্ব উইং হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাস্তবে এনবিআর নিজস্ব ক্ষমতা ও স্বাতন্ত্র্য প্রয়োগ করতে পারেনি। বরং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিবকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, যার ফলে একই ব্যক্তির অধীনে দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকায় বোর্ডের নীতিনির্ধারণী ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ভারসাম্যহীনতা ও সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করেছে। বোর্ডের নীতিনির্ধারণী ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজস্ব প্রশাসন গঠনের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ৩১ পয়সা, যা বৈশ্বিক বিবেচনায় সর্বনিম্ন। তুলনামূলক বিচারে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি ১০০ রুপি রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ৬১ পয়সা, মালয়েশিয়াতে প্রতি ১০০ রিঙ্গিতে রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ১ রিঙ্গিত এবং জাপানে প্রতি ১০০ ইয়েন রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে বিনিয়োগ করা হয় প্রায় ১.৭ ইয়েন। অর্থাৎ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অপ্রতুল বিনিয়োগের মধ্যেও স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গড়ে ১৬.৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রাজস্ব আহরণ করেছে, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত বিনিয়োগের সাথে কর-জিডিপি অনুপাত উন্নয়নের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোয় দ্বিস্তর বিশিষ্ট প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যবস্থা বিদ্যমান। বোর্ডের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো থেকে অনুমোদনের পর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এই দ্বিস্তর অনুমোদন ব্যবস্থার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মারাত্মক দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হয়। সুতরাং নেতৃত্বের দুর্বলতা, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক বিচ্যুতি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের ঘাটতি, বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোয় জটিলতা, এই সবকটি বিষয়ই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্পর্কে একটি ধারণা হলো, এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত কাঠামোগত সমস্যা, যা শুধু এনবিআর নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের খানা জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালের খাতভিত্তিক দুর্নীতির তালিকায় কর ও কাস্টমসের অবস্থান ছিল ১৪তম, যেখানে ২০২১ সালে এ খাতটি শীর্ষ ১৫-এর বাইরে ছিল এবং ২০১৭ সালে ছিল ১৩তম অবস্থানে। এই চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এনবিআরের দুর্নীতি প্রচলিত ধারণার বিপরীত।

বর্তমান প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, প্রশাসনিক তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এনবিআরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই দুর্নীতির অপবাদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

ছক ১: প্রধান ১৫ টি খাতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক দুর্নীতির খাতভিত্তিক খানা জরিপের তথ্য

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এনবিআর এর সদস্যদের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান অগ্রাহ্য করে নিয়োগ করায় এনবিআর পরিচালনার জটিল প্রক্রিয়াকে ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি এবং এর ফলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি। এ রিপোর্টে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন, নিরীক্ষা, অবকাঠামোয় বিনিযোগ বৃদ্ধিসহ নানা রকম সংস্কার প্রস্তাব করা হলেও রাজস্ব নীতি প্রণয়নকে পৃথক করার কোন সুপারিশ করা হয়নি (Chapter VI)।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত রাজস্ব বোর্ড সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি। তবে কমিটির প্রতিবেদনের একটি খসড়া কপি অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করে দেখা গিয়েছে যে, রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের মর্যাদায় স্বাধীন ও স্বশাসিত কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কাস্টমস ও ভ্যাট এবং আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্য হতে কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের সুপারিশও এতে করা হয়েছে। অন্যদিকে নীতি বাস্তবায়নের জন্য রাজস্ব বোর্ডের বিদ্যমান কাঠামো বহাল রেখে বোর্ডের মর্যাদা (status) বৃদ্ধি করে একে বিভাগের মর্যাদা প্রদান এবং কাস্টমস ও আয়কর থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, রাজস্ব নীতি আর বাস্তবায়ন পৃথক করতে হবে, এটি আইএমএফ এর শর্ত এবং এই শর্ত পূরণ না হলে বাংলাদেশ ঋণ পাবে না- এরকম একটি জোর প্রচারণা বাজারে চালু রয়েছে। এ বিষয়ে খোঁজখবর করে জানা যায় যে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে আইএমএফ এর অনেকগুলো সভা হয়েছে এই ঋণ আলোচনার শুরু থেকে। সেই সব আলোচনায় অন্য অনেক শর্ত নিয়ে আইএমএফের শর্তের প্রসঙ্গ এলেও রাজস্ব নীতি পৃথক করতেই হবে- এরকম শর্তের কথা আসেনি মর্মে আলোচনায় সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়। তাছাড়া, আইএমএফ যদিওবা অন্যান্য শর্তের সাথে এমন শর্ত দিয়েও থাকে, তা পূরণের আগে অবশ্যই বিশদ পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। গত শতকের আশির দশকে আইএমএফের Structural Adjustment Program (SAP) এর আওতায় কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দেয়া, বিএডিসি বিলুপ্ত করণসহ নানা রকম উদ্যোগ বাংলাদেশের কৃষি খাতকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। এসব কারণে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আইএমএফ এর ঋণ সুবিধা থেকে দূরেই থেকেছে। সুতরাং আইএমএফের সকল শর্তই যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

এই সকল সুপারিশের মধ্যে অন্য অনেক বিষয় থাকলেও কেবল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে নীতি প্রণয়ন এর কার্যক্রম সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগটিই কেন যেন দ্রুত গতিতে কার্যকর করার তাগিদ লক্ষ্য করা গেলো। এ লক্ষ্যে বিসিএস (কাস্টমস এন্ড এক্সাইজ) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডারের সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন দুটি যৌথভাবে প্রস্তাব প্রণয়ন করে দিলেও সেসব প্রস্তাবের মৌলিক বিষয়গুলো পরিবর্তন করে গোপনে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।

কোন সংস্কার মডেলের অনুসরণে রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে তা বোধগম্য নয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার মডেলের পরিপন্থী। বাংলাদেশে বর্তমানে যে মডেলটি রয়েছে, তা ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৪ সালের সেন্ট্রাল বোর্ড অব রেভিনিউ অ্যাক্ট এর মাধ্যমে গঠিত বোর্ডের মডেল। এই মডেলের দুই উত্তরসূরী ভারত ও পাকিস্তান এই মডেল বহাল রেখেছে, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর শক্তিশালী করা হয়েছে। আবার মডেলের প্রবক্তা ব্রিটেনেও মোটামুটি এমন মডেলই কার্যকর রযেছে। His Magesty’s Revenue and Customs (HMRC) ব্রিটেনের সর্বোচ্চ রাজস্ব সংস্থা, যার প্রধান চিফ এক্সিকিউটিভ এবং তিনি সরকারের বিশেষ সচিব পদমর্যাদার। ২০০৫ সালে ব্রিটেনের কাস্টমস ও ইনল্যান্ড রেভিনিউ একীভূত করে গঠিত হয় HMRC, যা আয়কর, কাস্টমস, এক্সাইজ, গেম্বলিং কর, জাতীয় বীমা নম্বর ইস্যুসহ বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করে। গত বিশ বছরে যত সফল রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার হয়েছে, কোথাও এরকম ডিভিশন মডেলের দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। সুতরাং আমরা কোন মডেল অনুসরণ করছি, সেটিও স্পষ্ট নয়।

আমরা এনবিআর তথা রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের বিরোধী নই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের দাবী দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। আমরা চাই এই সংস্কার যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে, দেশের স্বার্থ ও উন্নয়নধর্মী দর্শন এতে প্রতিফলিত হবে, রাজস্ব প্রশাসন অধিকতর কার্যকর, প্রগতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত হবে, এবং সংস্কার কোনো গোষ্ঠীগত কায়েমি স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হবে না। আমাদের মূল আপত্তির জায়গাগুলো নিম্নরূপ:

(ক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমের প্রকৃতি অত্যন্ত বিশেষায়িত এবং আইননির্ভর। আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাটসহ রাজস্ব আইন ও নীতিমালার প্রয়োগে দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা, পেশাগত দক্ষতা ও নীতিগত গভীরতা প্রয়োজন হয়। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষায়িত জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে নীতিনির্ধারণে অসামঞ্জস্য ও বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটবে- যা সরাসরি রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

(খ) প্রণীত অধ্যাদেশে উদ্দেশ্যমূলক ও বিরূপ সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী মহলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাংগঠনিক স্বাতন্ত্র্য ও পেশাগত স্বকীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছে, রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল কাঠামো বিনষ্ট করে রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কার্যক্রমটি একই সাথে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

(গ) সংস্কার হলে তা হবে ভালোর জন্য, উত্তম কিছু অর্জনের জন্য। রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারের জন্য জারিকৃত অধ্যাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি নিদারুনভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। জারিকৃত অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিদ্যমান যে নেতৃত্বগত সমস্যা রয়েছে, সেটাকেই রাখা হয়েছে, অন্য ফরম্যাটে, একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে। অর্থাৎ, সমস্যাকে স্বীকার তো করা হয়েই নি, বরং দুই বিভাগের সর্বোচ্চ পদে দুই নেতাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে সমস্যা আরো বাড়বে। বর্তমানে এনবিআরের প্রধান সরকার নিয়োগ করেন সচিবদের মধ্য হতে, এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্য হতে নয়। এনবিআরের মত একটি অতি টেকনিক্যাল ও পেশাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা। জারিকৃত অধ্যাদেশের মাধ্যমে পূর্বের ধারাবাহিকতাই বহাল রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো সংস্কার হয়নি, যেটি এনবিআর কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এর ফলে রাজস্ব প্রশাসনে উড়ে এসে জুড়ে বসার প্রথা চলতে থাকবে, যা রাজস্ব আদায় কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করবে;

(ঘ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিভক্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের লক্ষ্যে একটি বিশেষ পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য সংস্কার-সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদনসমূহ যথারীতি সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও, এই বিশেষ পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদনটি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি, এমনকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও সরবরাহ করা হয়নি। ফলে যে প্রতিষ্ঠানের সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত সকল সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পাবলিক করা হলেও এই রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক বিশেষ পরামর্শক কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করেই তড়িঘড়ি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিলুপ্ত করা হলো প্রত্যাশী সংস্থার সাথে কোন আলোচনা ব্যতিরেকেই, যা গভীর সন্দেহের উদ্রেক করে।

(৪) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত সংস্কার সময়ের দাবি। তবে এই সংস্কার হতে হবে বাস্তবমুখী, অংশীজনের মতামতভিত্তিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ মূল্যায়নের মাধ্যমে। জারিকৃত অধ্যাদেশটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি বিনষ্ট হবার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

আমাদের দাবী:

১. প্রণীত রাজস্ব অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা;

২. জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা;

৩. পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ক শ্বেতপত্র আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সকল অংশীজনদের মতামত নিয়ে সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করা।

আমরা চাই:

১. একটি দুর্নীতিমুক্ত রাজস্ব ব্যবস্থা:

২. একটি হয়রানিমুক্ত, সেবাধর্মী ও জনবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থা;

৩. রাজস্ব প্রশাসনের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন;

৪. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে টেকসই ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ;

৫. গবেষণা ও পরিসংখ্যান উইংসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশেষায়িত উইংসমূহের কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা জোরদার করা।

গতকালের ধারাবাহিকতায় আজকের কলম বিরতি কর্মসূচীতে সকলে একাত্মতা প্রকাশ করায় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। পাশাপাশি সম্মানিত করদাতা ও সেবাপ্রার্থীগনের সাময়িক অসুবিধার জন্য ঐক্য পরিষদ আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ মনে করে, তাঁদের এই সাময়িক ত্যাগ

দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এবং রাজস্ব ব্যবস্থার টেকসই সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য যে, আগামী ১৭/০৫/২০২৫ (শনিবার) সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ৩ টা পর্যন্ত একইভাবে এই কলম বিরতি চলমান থাকবে। পূর্বের মতোই আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, রপ্তানী কার্যক্রম এবং জাতীয় বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রম এই কর্মসূচীর আওতা বহির্ভূত থাকবে।