সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ : নকল এবং ভেজাল ওষূধে সয়লাব রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের ওষুধ বাজার। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পর্যন্ত এখন সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ। প্রশাসনের নাকের ডগায় এই অপকর্ম চললেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ওষুধ প্রশাসন ও র্যাবের তত্ত্বাবধানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কিছু অভিযান হলেও বাকিটা সময় সবাই একেবারে শুনশান নিরবতা।
সবচেয়ে ভয়াবহ খবর হচ্ছে- নকলের এই তালিকায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধই বেশি। আবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে এই অপকর্মে যাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে তাদের মধ্যে প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা এবং কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির অনেক নেতাও রয়েছে। গত মঙ্গলবার র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময় গ্রেফতার হয়েছেন কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক নেতা মিলনকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডীন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘নকল বা ভেজাল ওষুধ খেলে একজন রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন কেমিক্যালের প্রভাবে পঙ্গু বা বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারেন একজন সুস্থ মানুষ। আমাদের প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
গত মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিটফোর্ড এলাকার দু’টি গোডাউনে অভিযান চালায় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নেতৃত্বে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একটি গোডাউন থেকে ক্যান্সারের ড্রাগ, টিবির ওষুধ, সেনসোডাইন টুথপেস্ট ৩ ট্রাক এবং জীবন রক্ষাকারী নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ২ ট্রাক জব্দ করা হয়। আরেকটি গোডাউন থেকে শ্যাম্পু ও জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ জব্দ করা হয়। এসব ওষুধের বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকা। দু’টি গোডাউনের মালিক বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক নেতা মো. মিলন। অভিযানে দু’জনকে আটক করা হয়েছে। তবে মিলন পলাতক। একই অভিযোগে মিলনের বিরুদ্ধে আগের একটি মামলা রয়েছে।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যান্সার, কিডনির রোগ, হূদরোগ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ সবচেয়ে বেশি নকল হয়। এই ওষুধগুলো সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের এক অভিযানে ডায়াবেটিসের ইনসুলিনে পাওয়া গেছে সাবানের ফেনা। পাশাপাশি স্বল্প মূল্যের ওষুধও নকল হচ্ছে। খোদ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বললেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে ২৮৭টি প্রতিষ্ঠান ওষুধ তৈরি করছে। এর মধ্যে ৩০/৪০টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ মানসম্পন্ন। যা বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর অর্থ হল বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওষুধের মান খুব ভালো নয় বা তারা সঠিকভাবে ওষুধ তৈরি করছে না। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। এর অধিকাংশই ঢাকার বাইরে। ওষুধ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। ফলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুধু ভেজাল বা নকল ওষুধ নয়, ওষুধের মধ্যে যে যে উপাদান দেয়ার কথা তাও দেয়া হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের ওষুধে লেখা থাকছে ৫০০ মিলিগ্রাম। অথচ পরীক্ষার পর দেখা যায় সেটি আসলে ৫০০ মিলিগ্রাম নয়, ২০০ বা সর্বোচ্চ ২৫০ মিলিগ্রাম। ফলে চিকিৎসকের লেখা ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না। কারণ চিকিৎসক মনে করছেন, যে মাত্রায় ওষুধ রোগীকে দেয়া দরকার তা তিনি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে রোগীর শরীরে ওই মাত্রায় ওষুধ যাচ্ছে না। ফলে রোগীকে দ্বিগুণ ওষুধ খেতে হচ্ছে। এতে তার খরচও বাড়ছে।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত ডায়াবেটিসের দুইটি ও প্যারাসিটামল কম্ব্বিনেশনের একটি ওষুধ বাজারে পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট দোকান মালিক ও উৎপাদনকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিষিদ্ধ ওষুধসমূহ জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অনেকে এ ধরনের ওষুধ জব্দ করে অবহিতও করেছেন।’ তিনি বলেন, গত সাত মাসে ঢাকাসহ দেশে অভিযান চালিয়ে নকল, ভেজাল ওষুধ বিক্রি ও উৎপাদনের জন্য ৪৯৯ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ড্রাগ কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও মোবাইল কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ৫৪ লাখ ৭১ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা, ২০ জনকে কারাদণ্ড ও ১০ প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে।
নকল বা ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক শ্রেণির চিকিৎসক নানা ধরনের সুবিধা নিয়ে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা ভেজাল ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিচ্ছেন। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে ওই ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘আগে চিকিৎসকদের ওষুধের নমুনা দিলেই হতো। এখন আর ওষুধের নমুনা তারা নেন না। তাদের এখন নগদ টাকা দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে ওষুধ কোম্পানির চেক বর্তমানে পৌঁছে যাচ্ছে। কখনও কখনও বিদেশে যাওয়ার জন্য বিমান টিকিট, বাসার ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার, গাড়ি পর্যন্ত কিনে দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। চিকিৎসকের খ্যাতির উপর নির্ভর করে তার পেছনে কত খরচ করবে তারা।’
মো. আমিরুজ্জামান জানান, নীলফামারীর বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুরের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে নিষিদ্ধ ওষুধ “দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। গ্রামগঞ্জের হাতুরে ডাক্তাররা এসব ওষুধ প্রয়োগ ও বিপণন চালিয়ে যাচ্ছেন। এসকল কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাসহ ওষুধ ব্যবসায়ীরা এনিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। খবর দৈনিক ইত্তেফাকের