খোলা বাজার২৪ ॥ বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৫, পাইকগাছা, খুলনা : অবশেষে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন বীরাঙ্গনারা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী রোগ-শোকে আর অযত্নে অবহেলায় মৃত বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর কি হবে। সে কি পাবে না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ! এমন প্রশ্ন খুলনার পাইকগাছাসহ পাশ্ববর্তী কয়েক উপজেলার স্বাধীনতার স্ব-পক্ষে মানুষের। বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসীর জন্য কে আবেদন করবেন সরকারের কাছে ? মুক্তিযুদ্ধে গুরুদাসীর স্বামী-সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে রাজাকাররা। হৃদয়ে নির্মম যন্ত্রনা নিয়ে জীবনের শেষ সময় টুকু যেখানে কাটিয়েছেন তা গত ৭ বছরে সংরক্ষণ করা হয়নি। সোমবার (১২ অক্টোবর) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক গেজেটে ৪১বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। মন্ত্রণালয়ের গণসংযোগ কর্মকর্তা সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফ বলেন, পর্যায়ক্রমে সব বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ কম মোজা¤েœল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বার্থে বীরাঙ্গনারা অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের অবদান কখনোই ভোলা যাবে না। এ জন্য সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা সময় ও তত পরবর্তী মৃত বীরাঙ্গনাদের রাষ্টীয় স্বীকৃতি এবং তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ না করা হলে পরবর্তী প্রজ¤œ ভুলবে মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের অবদান।
১৯৭১ সাল। সারা দেশে যুদ্ধের ঘনঘটা। মুক্তিকামী নিরীহ বাঙালিদের ওপর চলছে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন। তাদের পাশবিক হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু, বৃদ্ধ, মহিলারাও। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করতে শুরু করেছে কখনো সম্মুখ যুদ্ধ আবার কখনো গেরিলা যুদ্ধ। এমনই এক পরিস্থিতিতে এক দিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর এদেশীয় রাজাকাররা হামলা চালায় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামে। ফুলবাড়ী গ্রামের গুরুপদ মন্ডল পেশায় দর্জি হলেও সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। স্বাধীনতাকামী অত্যন্ত সহজ-সরল বিনয়ী একজন মানুষ। ২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সংসার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি। রাজাকারদের ইন্ধনে পাক বাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়। একে একে পরিবারের সব সদস্যকে বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়। তার স্ত্রী গুরুদাসী মন্ডলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাক সেনাদের। নিজ স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এগিয়ে এলে গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামী, ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃতদেহ বীভৎস করে দেয়া হয়। এরপর গুরুদাসীর কোলে থাকা দুধের শিশুকে মাতৃক্রোড় থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাঁশে কাদা পানির ভেতরে। তারপর গুরুদাসীর ওপর হায়েনারা পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। পাক হানাদাররা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী গুরুদাসীকে উদ্ধার করে। নিজ চোখের সামনে স্বামী, ছেলেমেয়ের মৃত্যু এবং পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে গুরুদাসী ততক্ষণে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে উদ্ধার করে তাদের হেফাজাতে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ্য হতে পারেননি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় উদবাস্তের মতো ঘুরে এক সময় ফিরে আসেন স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত খুলনার পাইকগাছায়। দেশ স্বাধীনের পর গুরুদাসীর খবর আর কেউ রাখেনি। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী ভিক্ষা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যান। হাতে ছোট্ট লাঠি, মানুষকে হাসতে হাসতে ভয় দেখানো আর হাত পেতে ২ টাকা চেয়ে নেয়াÑএভাবেই গুরুদাসীর দিন কাটতে থাকে। গুরুদাসী হয়ে ওঠেন এলাকার সবার কাছের মানুষ, পরিচিত মুখ। কোথাও একদম বসতেন না তিনি। সারা দিন হাঁটাই ছিল তার কাজ। কখনো কখনো আনমনা হয়ে যেতেন। স্মৃতির পাতায় হারানো দিনগুলো খোঁজার চেষ্টা করতেন হয়তো বা। তখন কেউ সামনে এলে জিজ্ঞাসা করতেন ‘কবে বিচার পাবেন’। সবার কাছে তিনি মাসি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরে পাইকগাছা উপজেলার ততকালীন চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী ও নির্বাহী কর্মকর্তা মিহির কান্তি মজুমদার কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় গুরুদাসীর বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। সেখানেই অনাদরে, অযতেœ, অভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন তিনি। ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর ভোররাতে নিজের শয়নকক্ষে তার মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখে পার্শ্ববর্তী লোকজন। গুরুদাসীর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষ। শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন গুরুদাসীর প্রতি। রাষ্টীয় স্বীকৃতি না থাকায় আর দশজন মানুষের মতো সাধারণভাবে সম্মান জানিয়ে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হয়। ২০০৯ সালে ৮ ডিসেম্বর ৭১-এর বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই নীরবে পেরিয়ে যায়। একে একে নিরবে পেরিয়েছে ৬টি বছর। প্রায় ৭ বছরেই গুরুদাসীমাসিকে সবাই যেন ভুলতে বসেছে। সরেজমিন মঙ্গলবার দেখা গেছে, গুরুদাসীর জীবনের শেষ সময় বসবাসের খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি বাড়িটির চার পাশে মানুষ মল-মূত্রত্যাগ করছে। পাশে চলছে জুয়ার আসর। বাড়ীটিতে রাতে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। রাত-দিনে নেশাখোরদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গঠণ করা হয়েছিল বীরাঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ। আর তার বসবাসের বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির ঘোষণা দেয়া হয় ওই সময়। আজ পর্যন্ত তার কোনো বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়নি। অযতেœ আর অবহেলায় পড়ে আছে গুরুদাসী মাসির স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। কপিলমুনি গুণিজন স্মৃতি সংসদের সভাপতি আঃ সবুর আল- আমিন বার্তাসংস্থা এফএনএকে বলেন, শুধু জীবিত নয়, মৃত বীরাঙ্গনাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্টীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। মৃত গুরুদাসীকে রাষ্টিয় স্বীকৃতি দিয়ে গুরুদাসীর স্মৃতি রক্ষার জন্য সরকারের কাছে তিনি দাবী জানান। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুদাসীর আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসির স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুরি উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।