খোলা বাজার২৪,বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫: ‘স্বপ্নেও ভাবিনি, আমার স্বামীর হত্যার বিচার পাব। আমাদের দুঃখমোচন হবে। কিছুদিন আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আমরা সুবিচার পেয়েছি। জানি, আমার স্বামীকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমাদের বুকের ওপর যে দুঃখের পাথর ছিল, তা নেমে গেছে। এবার পালন করছি, নির্ভার এক অন্য রকম বিজয় দিবস।’
বিজয় দিবসের অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী কাছে এভাবে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেন।
আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বাংলাদেশের সবচেয়ে আনন্দের, বড় প্রাপ্তির দিন। আজকের দিনটিকে অন্য রকম এক বিজয় দিবস, তরুণ প্রজন্মের উত্তরণের বিজয় দিবস বলে মনে করছেন শহীদ পরিবারের সদস্য ও বিশিষ্টজনেরা।
দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম আর লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহু আকাক্সিক্ষত বিজয়ের এ দিনটি এসেছিল। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৪৪ বছর আগের এই দিনে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হাতের অস্ত্র ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বিজয়ী বীর বাঙালির সামনে। আত্মসমর্পণের দুদিন আগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ পর্যন্ত পাঁচটি মামলার রায় কার্যকর হয়েছে। এতে চারজনের ফাঁসি ও একজনের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ ১১ জনের মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
বিজয় দিবসে এই বিচারের ব্যাপারে অনুভূতি জানাতে গিয়ে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহীদ রেজা নূর বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে অন্তত একজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তাই এবারের বিজয় দিবসটা অনেকটা স্বস্তির। শুধু শহীদ পরিবারের কাছে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালু হওয়ার পর সেখান থেকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে। আশা করি, এটা চালু থাকবে।’
শহীদ বুদ্ধিজীবী সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, ‘চারজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের ফলে আমাদের হৃদয়ে যে অপমান ও বেদনার ভার ছিল, সেটা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বিজয় দিবসে সবাই গতকাল রাতে বেরিয়ে ছিলাম। তখন দেখলাম, তরুণেরা উচ্ছ্বাস করছে, আনন্দ করছে। এবারের বিজয় দিবস শুধু আমাদের কাছে নয়, দেশের সব মানুষের কাছেই নির্ভারের।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বাঙালি জাতি যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে, এ জন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। সেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে আলবদর কমান্ডার মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এ জন্য এবারের বিজয় দিবসটা অন্য রকম। এর মাধ্যমে আমরা বিচারিক সংস্কৃতির দিকে ফিরে গেছি।’ তিনি বলেন, ‘এবারের বিজয় দিবসে প্রতিটি পাড়ায় তরুণদের নানা আয়োজনে ব্যস্ত দেখছি। তরুণদের এই উত্তরণ বাংলাদেশকে নতুনভাবে জাগাবে বলে আমি মনে করি।’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘এই বিজয় দিবস আগামী সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়তে নতুনভাবে সঞ্চার করেছে। কারণ কিছু দিন আগেই দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কণ্ঠে জামায়াত নিষিদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এবারের বিজয় দিবসে এক অন্য রকম অনুভূতি।’
ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘পরবর্তী ১৬ ডিসেম্বর যেন আমাদের দাবি করতে না হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে হবে। এ জন্য চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সব বিচার শেষ করতে হবে। বিজয় দিবসে আমাদের দাবি, বুদ্ধিজীবীদের যারা হত্যা করেছে শুধু তাদের নয়, তাদের এ দেশীয় সব দোসরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।