এ এম এম শওকত আলী ।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ১১ জুলাই ২০১৬: সুশাসন নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ থেকে অনেক আলোচনা দেশে-বিদেশে হয়েছে। এ আলোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বিদেশি সাহায্যদাতা গোষ্ঠী সুশাসন অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এ শব্দটির সংজ্ঞা নিয়েও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা ব্যাখ্যা দিয়েছে। এ ব্যাখ্যার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা নির্বাচিত শাসক দলের একচেটিয়া অধিকার নয়। শাসনব্যবস্থার অন্য অংশীদার হবে রাষ্ট্র বা সরকারবহির্ভূত সংস্থাগুলো। অর্থাৎ এদের মতামত গুরুত্বসহকারে শুনতে হবে এবং সুপারিশ আমলে নিতে হবে। সুশাসনের এ বৈশিষ্ট্য সনাতনী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাকস্বাধীনতাসহ নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার। সনাতনী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধানকেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার মূল চালিকাশক্তি বলে গণ্য করা হয়। সংবিধানে সুশাসন অর্জনের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও নিশ্চিত করার বিষয়টিও স্বীকৃত। এ সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, সুশাসনের অভাব নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সুশাসনের বিষয়টি সময় সময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। সুশাসন একমাত্র রাষ্ট্র বা সরকারবহির্ভূত সংস্থার মতামত প্রকাশ ও আমলে নেওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। এর ব্যাপ্তি বহুমুখী। সনাতনী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতাসীন সরকারকেই নাগরিক সুরক্ষাসহ তাদের জীবনযাত্রার বহু ধরনের সেবা নিশ্চিত করতে হয়। শাসন ব্যবস্থাপনায় আইন ও বিধিসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে সংবিধান অনুযায়ী কোনো নাগরিক জনস্বার্থ সুরক্ষাবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। অন্যদিকে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত না হলে নির্বাচিত সংসদেও এ নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারে এবং হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যেকোনো দেশের শাসন ব্যবস্থাপনার অন্যতম বাস্তবতা হলো নাগরিক অধিকার ব্যাহত হলেই তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি দুরূহ। এর মধ্যে রয়েছে আইনি প্রতিকারসহ অন্যান্য ক্ষেত্র। শেষোক্ত বিষয়ে সাধারণত নাগরিক প্রতিবাদ দৃশ্যমান হয়। এ প্রতিবাদের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশে হরতাল বা ধর্মঘট হয়। সাধারণত বিরোধী রাজনৈতিক দল হরতাল বা ধর্মঘটের আহ্বান দিয়ে থাকে। তবে ধর্মঘট অরাজনৈতিক সংস্থাও আহ্বান করে থাকে। ইদানীংকালে হরতালের বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। হরতাল হলে স্বাভাবিক নাগরিক জীবন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। এর বিকল্প হিসেবে এখন মানববন্ধনের বিষয়টি দৃশ্যমান। এ ধরনের মানববন্ধন সরকারি কার্যকলাপ বা নীতি বাস্তবায়নে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে মানববন্ধন এখন একটি স্বীকৃত প্রতিবাদের ধরন। অনেকের মতে, গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন অর্জন সম্ভব নয়। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবে তা না-ও হতে পারে। কারণ গণতন্ত্রে নির্বাচন বা নির্বাচিত সরকার সমার্থক নয়। গণতন্ত্র যদি মুক্ত আলোচনার পথ প্রশস্ত না করতে পারে, তাহলেই সুশাসন ব্যাহত হবে। ২৯ জুন এক দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে যে একজন ‘বিরোধীদলীয়’ সংসদ সদস্য মন্তব্য করেছেন, ‘দেশে প্রশাসন আজ প্রশ্নবিদ্ধ নয়, সুশাসন গুলিবিদ্ধ।’ চলমান বাজেট আলোচনার সময় তিনি এ মন্তব্য করেন। এ মন্তব্যের স্বপক্ষে তিনি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একাধিক ক্ষেত্রের দুর্বলতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও লুটপাট, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ চুরি। গত ১০ বছরে গড়ে লাখ কোটি টাকার অর্থপাচার, ২০০৪ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত এক হাজার ৭১৫ ব্যক্তির বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুবরণ। গত মার্চ থেকে ১৩টি গুপ্তহত্যা। নিহত তনুর মায়ের আকুতি ইত্যাদি।
সুশাসন যে আজ গুলিবিদ্ধ এমন কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। যেসব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা তিনি উল্লেখ করেছেন তা কারো অজানা নয়। তবে সংসদে প্রশাসন যে আজ গুলিবিদ্ধ এমনটি কখনো শোনা যায়নি। যে সংসদ সদস্য এমন উক্তি করেছেন, তা কঠোর হলেও দ্বিমত প্রকাশ করা যায় না। তবে গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে বলা যায় যে গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রথম ব্যাহত হয় সত্তরের দশকের মধ্য ভাগে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর। প্রথম গুলিবিদ্ধ হয় ১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। এরপর গুলিবিদ্ধ হয় ১৯৮২ সালে। এরপর ‘গুলিবিদ্ধে’র ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয় দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সংঘাতপূর্ণ আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। আর্থিক খাতের বিশাল দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনার বিষয়টি ক্ষমতাসীন সরকারের অর্থমন্ত্রী ‘সাগরচুরি’ হিসেবে গণ্য করেছেন উল্লেখ করে সংসদ সদস্যের কয়েকটি প্রশ্ন ছিল। এক. এর জন্য দায়ী কে? দুই. চুরি বন্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে? তিন. বাজেটে এর কোনো রূপরেখা নেই কেন? তাঁর আরো মন্তব্য ছিল ‘আমরা এই সংসদে লুটপাট নিয়ে আলোচনা করি, আর বাইরে দ্বিগুণ হারে এই লুটপাট চলতে থাকে। সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল, ব্যাংকের ৩৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। জনগণের এই টাকা অবলোপনের অধিকার কে দিয়েছে?
যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে জবাবদিহির বিষয়টি যে ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু বাজেটের সাধারণ আলোচনায় এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া না গেলেও যে বিষয়টি মুখ্য এবং কমবেশি সবারই জানা, তা এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনায় কিছুসংখ্যক ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অনেকেই বরখাস্ত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচার শেষে রায় ঘোষণার পর আরো কিছু তথ্য জানা যাবে। এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কিছু বিরূপ তথ্য অতীতে দেখা গেছে। তথ্যটি ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, একমাত্র পদচ্যুতি ছাড়া। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যও ছিলেন।
সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যের অন্য বিষয় ছিল ব্যক্তিনিরাপত্তার দারুণ অভাব। ব্যক্তিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের তথা ক্ষমতাসীন সরকারের। চট্টগ্রামের এসপির স্ত্রী হত্যার বিষয় উল্লেখ করেই নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গে বলা হয়। এ হত্যা ঘটনার কিছুসংখ্যক অভিযুক্ত ব্যক্তি এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হলেও এসপিকে গভীর রাতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের রহস্য নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি রয়েছে মর্মে মিডিয়ায় ক্রমাগত সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। ২৯ জুন একটি দৈনিকের সর্বপ্রধান খবরের শিরোনাম ছিল ‘বাবুলকে আসামিদের মুখোমুখি করা নিয়ে বিভ্রান্তি।’ এর অন্যতম অংশ ছিল সন্দেহভাজন ও পুলিশের সোর্স কামরুল শিকদার ওরফে মুছার কোনো খোঁজ নেই। সরকার বা পুলিশের পক্ষ থেকে বাবুল আক্তারের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ না করায় তাঁকে নিয়ে মিডিয়ায় নানা ধরনের জল্পনাকল্পনাপ্রসূত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এ বিষয়ে আরো তথ্য প্রদানের সময় এখনো হয়নি। সুশাসন রক্ষায় রাষ্ট্রীয় কার্যসম্পাদনে স্বচ্ছতার বিষয় সব সময়ই উল্লেখ করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে চলমান ঘটনার বহুমুখী বক্তব্য অস্বচ্ছতা বা স্বচ্ছতার অভাবই দৃশ্যমান করেছে। এ নিয়ে ধারণা অমূলক হবে না যে সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে এমন ধারণার বিপক্ষে বলা যায় যে তদন্তের স্বার্থে শতভাগ স্বচ্ছতা কোনো দেশেই নিশ্চিত করা হয় না।
৩০ জুন দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবি পরিচালিত জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপ্তি যেকোনো দেশের সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কারণ দুর্নীতির অপর নাম অব্যবস্থাপনা বা জবাবদিহির অভাব। বসতবাড়িভিত্তিক দুর্নীতিসংক্রান্ত জরিপের ফল কারো জন্য সুখকর নয়। এ জরিপে রাষ্ট্রীয় সেবা প্রদানকারী কিছু সংস্থার দুর্নীতির মাত্রা দৃশ্যমান। জরিপভুক্ত বসতবাড়ির শতকরা ৬৭.৮ শতাংশ ঘুষের বিনিময়ে সেবা করেছে। কী কারণে? কারণ হলো—এক. ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যায় না (৭০.১); দুই. তথ্যের অপ্রতুলতা (৩৩.৩); তিন. নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য (১৬.৬); চার. ঝামেলা ও জটিলতা এড়ানোর জন্য (২৬.৫); পাঁচ. নির্ধারিত সময়ের আগে সেবা পাওয়ার জন্য; ছয়. প্রভাবিত করার লক্ষ্যে এবং সাত. অন্যান্য। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে দুর্নীতির মাত্রা টাকার অঙ্কে বেড়েছে প্রায় ৮০ গুণ। পাসপোর্ট অধিদপ্তর দুর্নীতির শীর্ষে, যা এর আগে মিডিয়ায় প্রকাশিত কিছু সংবাদও তা প্রমাণ দেয়। এর পরই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তারপর দুঃখজনক হলেও সত্য শিক্ষা খাত। এরপর বি আরটিএ। অতীতে প্রায় সব সময়ই দলমত-নির্বিশেষে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারকরা টিআইবির প্রকাশিত কোনো তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন। ৩০ জুন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতিনির্ধারকদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা